সংগীতজ্ঞ সত্য সাহা : ধ্বংসের মুখোমুখি তাঁর জমিদার বাড়ি

ছবিটি সংবাদ প্রতিবেদকের তোলা।

মো. মোতাহের উদ্দিন মাজেদ, হাটহাজারী থেকে >>>
তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়/দুঃখের দহনে করুন রোধন তিলে তিলে তার ক্ষয়, তিলে তিলে তার ক্ষয়- এই বিখ্যাত গানটির সুরকার ও শিল্পী সত্য সাহা। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রাঙ্গণ ও সংগীত জগতে যে মানুষটির সৃষ্টি অবিস্মরণীয়; সেই সত্য সাহার জন্ম চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী উপজেলার নন্দীরহাট গ্রামের ঐতিহ্যবাহী জমিদার পরিবারে।
হাটহাজারী উপজেলার নন্দীরহাট গ্রামটিকে ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক-বাহকও বলা চলে। ঐতিহাসিক ও পুরাকীর্তির নিদর্শনের ধারক-বাহক এই নন্দীরহাট গ্রামটিতে রয়েছে বেশ কয়েকটি জমিদার বাড়ি। বৃটিশ আমলে এই গ্রামে বাস করতেন বেশ কয়েকজন জমিদার। তাঁদের একজন জমিদার শ্রী লক্ষ্মীচরণ সাহা। মূলত শ্রী লক্ষ্মীচরণ সাহার এই জমিদার বাড়িটি বর্তমানে সত্য সাহার জমিদার বাড়ি হিসেবে পরিচিত।

প্রয়াত সত্য সাহা।

এই বাড়িটি প্রায় ৫ একর জায়গার উপর দুই গম্বুজবিশিষ্ট দ্বিতল বাড়ি। বাড়িটি প্রাচীনকালের রাজা-বাদশাহ্দের মনের রং তুলিতে অংকিত কারুকাজসমৃদ্ধ দৃষ্টিনন্দন পুরাকীর্তি। জমিদার শ্রী লক্ষ্মীচরণ সাহা ১৮৯০ সালে এই বাড়িটি তৈরি করেন। জমিদার শ্রী লক্ষ্মীচরণ সাহা, মাদল সাহা ও নিশিকান্ত সাহা এই জমিদারির সূচনা করেন বলে জানা যায়। পরবর্তীতে লক্ষ্মীচরণ সাহার বড় ছেলে প্রসন্ন কুমার সাহা এই জমিদারি প্রথা চালিয়ে যান।
প্রসন্ন কুমার সাহার প্রথম স্ত্রীর ২ ছেলের একজন সংগীতজ্ঞ সত্য সাহা জন্মগ্রহণ করেন ১৯৩৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর। সত্য সাহার শৈশব কেটেছে এই গ্রামে। জমিদার বংশের ছেলে সত্য সাহা শান-শওকত, বিলাসবহুল জীবন কাটাতেন। পরবর্তীতে শিক্ষা ও কর্মজীবনের তাগিদে ঢাকায় পাড়ি জমান। স্বকীয় গুণে গুণান্বিত ব্যক্তিটি যখন সারাদেশে নিজের পরিচিতি গড়ে তুলেছেন; তখন থেকেই নন্দীরহাটে অবস্থিত এই বাড়িটি সত্য সাহার বাড়ি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
১৯৪৬-১৯৪৮ এর মাঝামাঝি সময়ে সত্য সাহা নারায়ণগঞ্জ রামকৃষ্ণ স্কুল থেকে এণ্ট্রান্স পাশ করেন এবং ১৯৫১ ও ১৯৫২ সালে ভারতের কলকাতা বিদ্যাসাগর কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। ১৯৬৪ সালে সুভাষ দত্ত পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র সুতরাং- এ সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে আতœপ্রকাশ করেন। বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় নায়িকা কবরী সত্য সাহার হাত ধরে এ জগতে আসেন। চলচ্চিত্রনির্মাতা দিলীপ বিশ্বাস ‘সমাধি’ নামক ছবি বানাবেন। গীতিকার গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মালিবাগের বাসায় সুরকার সত্য সাহা গানটির সুর করেন এবং এর রেকর্ডিং হয় কাকরাইলের ইপসা রেকর্ডিং স্টুডিওতে। পরবর্তীতে গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়।
তিনি সুতরাং (১৯৬৪), রূপবান (১৯৬৫), ১৩নং ফেকু ওস্তাগর লেন (১৯৬৬), ফির মিলেঙ্গে হাম দোনো (১৯৬৬), ভাওয়াল সন্ন্যাসী (১৯৬৬), চাওয়া পাওয়া (১৯৬৭), আয়না ও অবশিষ্ট (১৯৬৮), মোমের আলো (১৯৬৮), এতটুকু আশা (১৯৬৮), বাঁশরী (১৯৬৮), আবির্ভাব (১৯৬৮), নীল আকাশের নিচে (১৯৬৯), আলিঙ্গন (১৯৬৯), দীপ নেভে নাই (১৯৭০) সহ অসংখ্য ছবিতে সুরারোপ করেন। আগুনের পরশমণি ও অজান্তে সিনেমায় সঙ্গীত পরিচালনার জন্য ও সুরকার হিসেবে চুড়িওয়ালা ছবিতে তিনি সংগীত পরিচালনা করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন। ২০১৩ সালে মরণোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করেন তিনি।
তাঁর স্মৃতিঘেরা প্রাচীন ঐতিহ্য সম্বলিত হাটহাজারির এই জমিদার বাড়িটি ইতিহাস ঐতিহ্যের সাক্ষী হয়ে আজও টিকে আছে- তবে মুমূর্ষ অবস্থায়। বাড়িটির চারপাশে আছে দৃষ্টি নন্দন ফসলী জমি, গাছ-গাছালি, তিনটি পুকুরসহ প্রকৃতির সাথে অপরূপ মেলবন্ধন। ১৯৭৫ সালে সত্য সাহার প্রযোজনায় ও সংগীত পরিচালনায় অশিক্ষিত চলচ্চিত্রের সম্পূর্ণ শ্যূটিং এই জমিদার বাড়িতে হয়। টানা ১৫ দিন এই ছায়াছবির শ্যূটিং করেন সত্য সাহা। অথচ কালের সাক্ষী এই জমিদার বাড়ি আজ ধংসের মুখে।

সত্য সাহার ছেলে জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক ইমন সাহা।

স্থানীয় লোকজনের সাথে আলাপকালে তারা দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, এই বাড়িতে তেমন কেউ থাকেন না। তবে সত্য সাহার ভাই এবং ভাইয়ের ছেলেরা থাকেন এই বাড়িটির পেছনের বাড়িতে। সত্য সাহার সন্তান জনপ্রিয় সংগীত পরিচালক ইমন সাহা থাকেন ঢাকায়। পুজা -পার্বনে তিনি এখানে আসেন। বাড়িটিতে আছে পুজা মন্ডপ, শান বাঁধানো পুকুর ও ঘাট। পুকুরের পাড়েই আছে পারিবারিক শ্মশান। নন্দীরহাট বাজারের মূল সড়কের পূর্বপাশে শ্রী শ্রী নিস্তারিণী কালী মন্দির অবস্থিত। এই বাড়িটির সম্মুখেই সত্য সাহার সমাধিস্থল।
সরেজমিনে দেখা যায় বাড়িটির দেয়ালের পলেস্তরা ভেঙ্গে পড়ছে। খুবই ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় বাড়িটি দাঁড়িয়ে আছে। তাই ঐতিহাসিক ও পুরাকীর্তির নিদর্শন- এই বাড়িটি রক্ষণাবেক্ষণে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের উদ্যোগ জরুরি বলে সংশ্লিষ্ট বিশিষ্টজনেরা মত দিয়েছেন।

ডিসি/এসআইকে/এমএমইউএম