কেমন আছেন ত্রিপুরা পল্লীর মানুষেরা?

গত ১৪ মার্চ ত্রিপুরা পল্লীতে হাম-রুবেলা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে চট্টগ্রামের সংগঠন ভোরের আলো। জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র মীনা-রাজু-মিঠু পল্লীর অধিবাসীদের সাথে কাটায় আনন্দঘন মূহুর্ত।

মোহাম্মদ জিপন উদ্দিন ও আজাদুল ইসলাম , হাটহাজারি থেকে ফিরে >>> 
বাংলাদেশে বসবাসকারী ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর সংখ্যা মোট ৪৫টি। যা মোট জনসংখ্যার ১.১০%। এ ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর বেশিরভাগই কৃষি কাজ করে জীবনযাপন করে। সাধারণত তারা পাহাড়ি এলাকা ও গ্রামাঞ্চলে বসবাস করেন। নানান কারণেই এই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে আমরা তেমন কোনো খবরাখবর রাখি না। তারাও কখনো তাদের বিষয়ে আলোচনা সৃষ্টিমূলক কিছু করে না। বাংলাদেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডজুড়ে এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষের সামাজিক প্রথা বিশাল জায়গাজুড়ে স্থান করে আছে। বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বৈচিত্রেও এই জনগোষ্ঠীগুলোর বড় ধরণের অবদার অনস্বীকার্য। বিশেষত বৃহত্তর চট্টগ্রামে অবস্থিত বান্দরবান, খাগড়াছড়ি ও রাঙামাটি অঞ্চল নিয়েই আমাদের সকল রাখঢাক পরিলক্ষ্যিত হয় সর্বদা।

পল্লীর পাহাড়ের চূড়ায় থাকা ত্রিপুরা পরিবারগুলোর জন্য সমতলে তৈরি বাড়ি।

চট্টগ্রাম জেলায় যে কিছু ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে তাও কিন্তু বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ জানতো না। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুণ্ডে অজ্ঞাত রোগে ৯ শিশুর মৃত্যু এবং ২০১৮ সালে হাটহাজারী উপজেলায় ৪ শিশুর মৃত্যু জানান দেয় এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর বসবাস রয়েছে। শহর থেকে খুব কাছে হলেও নানান কারণে এই জনগোষ্ঠী বঞ্চিত ছিল সকল সরকারি সুযোগ-সুবিধা থেকে। বেশ কিছু শিশুর মৃত্যুর পর চট্টগ্রামের দুই উপজেলা যথাক্রমে সীতাকুণ্ড ও হাটহাজারীর দুইটি ত্রিপুরা পল্লী আলোচনায় আসে।
শিশু মৃত্যুর পর সরকারি-বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠান ও কর্তৃপক্ষ নড়েচরে বসে। এই জনপদে যোগাযোগ সৃষ্টির জন্য সড়ক নির্মাণ, অবকাঠামোগত উন্নয়ন, এসব ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর স্বাস্থ্য সুরক্ষামূলক উদ্যোগ এবং তাদের পরিবেশ সম্মত বাসস্থান নিশ্চিতে নানান উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় সরকারি পর্যায়ে। প্রায় তিন বছর পর সেই আলোচিত ত্রিপুরা পল্লীর বর্তমান পরিস্থিতি জানতে আমরা দৈনিক চট্টগ্রাম পরিবার গিয়েছিলাম ত্রিপুরা পল্লীতে। চট্টগ্রামের হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়নের পশ্চিমে অবস্থিত ছোট্ট একটি গ্রাম ‘মনিয়া ত্রিপুরা পল্লী’। ওই গ্রামে পাহাড়ের চূড়ায় চূড়ায় বসবাস করে ৫৬টি পরিবার, যেখানে মোট ৩৭২ জন মানুষ একই সাথে একটি পরিবারের মত জীবন পরিচালনা করে। তারা সাধারণত বেশিরভাগই কৃষক, কৃষি কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করেন। তাদের ছেলে-মেয়েরাও বেড়ে উঠছে পাহাড়ি কৃষি-খামারে কাজ করে। গত কয়েক বছর আগেও এখানকার কোনো শিশুই পড়ালেখায় যুক্ত ছিল না। কিন্তু আলোচিত হাম রোগে আক্রান্ত হয়ে শিশু মৃত্যুর পর এখানে সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে পড়ালেখার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। এই এলাকায় আরেকটি ত্রিপুরা পল্লী রয়েছে যা পূর্বদিকে অবস্থিত। সেখানেও ৫৪টি পরিবারের প্রায় সাড়ে তিনশত অধিবাসীর বসবাস। 

এভাবেই পাহাড়ি চূড়ায় বসবাস করেন ত্রিপুরা পল্লীর অধিবাসীরা।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় সব পরিবারই আছে পাহাড়ের চূড়ায়। বর্ষা মৌসুমে মারাত্মক দুর্ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা থাকলেও পাহাড় চূড়া, ঢালুতেই তাদের বসবাস। বর্ষাকালে পোহাতে হয় নানা ঝামেলা। যদিও এখানকার প্রতিটি পরিবারের জন্য ত্রিপুরা পল্লীর সমতল জায়গায় সরকারিভাবে গড়ে তোলা হচ্ছে বসতঘর। কিছু বসতঘর নির্মাণ শেষ হলেও আরো বেশ কিছু ঘর নির্মাণাধীন বলে জানা গেছে। দুই রুমের প্রতিটি ঘরের সামনে দুই দরজা বিশিষ্ট বারান্দা, ঘরের পেছনে পাকের ঘর ও টয়লেট সুবিধাসম্পন্ন এসব ঘর দ্রুতই ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পরিবারগুলোকে হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছেন এখানকার পাড়াপ্রধান সচীন কুমার ত্রিপুরা।
তিনি দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, আমাদের পল্লীতে ৫৬টি পরিবার, আমরা সবাই একসঙ্গে এক পরিবারের মত বসবাস করি। আমাদের মধ্যে কোনো ঝগড়া-বিবাদ নেই। যদিওবা আমরা আগে খুব খারাপ অবস্থায় ছিলাম। কিন্তু বর্তমানে সরকার আমাদের প্রায় সব ধরণের চাহিদা পূরণ করতেছে। সরকার আমাদের জন্য চলাচলের জন্য রাস্তা সংস্কার, শিক্ষা ব্যবস্থা, পানি ব্যবস্থা এবং গ্রামের যে সব পরিবার পাহাড়ের একদম চূড়ায় বসবাস করে তাদের জন্য আমরা ১৬টি ঘরের আবেদন করেছিলাম, তারমধ্যে ৬টি ঘর নির্মাণ হয়েছে এবং আরও তিনটি ঘর খুব শীঘ্রই নির্মাণ করা হবে। বর্তমান হাটহাজারী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোহাম্মদ রুহুল আমিন উপজেলায় আসার পর আমরা সব ধরণের সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছি। তিনি নিয়মিতভাবে আমাদের খোঁজ-খবর রাখেন।

গত ১৪ মার্চ ত্রিপুরা পল্লীতে হাম-রুবেলা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে ভোরের আলো নামে একটি সংগঠন। ক্যাম্পেইনে যোগ দেয় জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র মীনা-রাজু-মিঠু। পল্লীর অধিবাসীদের সাথে তারা খুব আনন্দঘন মুহুর্ত পার করে।

গত ১৪ মার্চ ত্রিপুরা পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে জাতীয় হাম-রুবেলা ক্যাম্পেইন পরিচালনা করছে স্থায়িত্বশীল জনসচেতনতা সৃষ্টিমূলক সংগঠন ভোরের আলো। জেলা তথ্য অফিস এবং ইউনিসেফ এর সহায়তায় তারা দিনব্যাপি সেখানে বসবাসরত ত্রিপুরা পরিবারগুলোতে গিয়ে হাম-রুবেলার টিকাদান সম্পর্কে তথ্য প্রদান করে। ভোরের আলো’র প্রতিষ্ঠাতা মো. শফিকুল ইসলাম খান জানান, এখানে পরিবারগুলোর ঘর একসাথে নয়। এক একটি পাহাড়ে এক বা দুইটি পরিবার বসবাস করে। সে হিসেবে এখানে অনেকগুলো পাহাড় রয়েছে। আমরা প্রতিটি পাহাড়ে অবস্থিত ত্রিপুরা পরিবারগুলোতে যাচ্ছি যাতে তারা আসন্ন হাম-রুবেলা ক্যাম্পেইনে তাদের শিশুদের হাম-রুবেলার টিকা দেয়। এখানে জনপ্রিয় কার্টুন চরিত্র মীনা-রাজু-মিঠুকে দিয়ে আমরা তাদের এসব তথ্য দিচ্ছি। তিনি বলেন, তারা মীনা-রাজু-মিঠুকে কখনো দেখেনি। তাই শিশুরা ও মায়েরা প্রথম প্রথম একটু ভয় পেয়েছে। তবে খুব দ্রুতই আমরা তাদের সাথে মিশতে পেরেছি। তারাও আমাদের গ্রহণ করেছে। 
সরেজমিনে দেখা যায়, ত্রিপুরা পল্লীর সব পরিবার পাহাড় থেকে চুইয়ে পড়া পানিই পান করেন। যদিও তাদের জন্য গভীর নলকূপ তৈরি করে দেয়া হয়েছে। কিন্তু নলকূপের পানির চাইতে পাহাড় বেয়ে আসা পানিই তারা পান করে বেশি। তাদের জন্য পল্লীর খুব কাছেই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে। এখানকার অনেক শিশুকে বিদ্যালয় থেকে আসতেও দেখা যায়। তবে পল্লীর অধিবাসীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আর্থিকভাবে অস্বচ্ছল এসব পরিবার এখনো নানানভাবে চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি মোকাবেলা করছে নিজ উদ্যোগেই। এখানে মাসে একবার স্বাস্থ্যকর্মীরা আসেন। পরিবারগুলোর অনেক সদস্য এখন উপজেলা কিংবা শহরে গিয়ে চাকুরি করার চেষ্টা করছে সংসারে স্বচ্ছলতা আনয়নে। অনেক পরিবারকেই অর্থকরী ব্যবসা গরু ও শূকর পালন করতে দেখা গেছে।

ডিসি/এসআইকে/এমজেইউ