ভয়-হুমকিতেও নির্বাচনে থাকছেন আ’লীগের বিদ্রোহীরা

সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি।

সুমাইয়া নাজনীন, নগর প্রতিবেদক >>>
করোনা ভাইরাস আতঙ্কে সারা বিশ্বের মতোই বাংলাদেশও অচলাবস্থার দ্বারপ্রান্তে। মহামারির এই ভাইরাস আতঙ্কে সাধারণ মানুষ। আসন্ন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনী প্রচারণাও চলছে ঢিমেতালে। বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন চসিক নির্বাচন অনুষ্ঠানে অনড় এখনো। এ নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে চলছে ইসির তীব্র সমালোচনা। অন্যদিকে নির্বাচনী মাঠে একের পর এক সহিংসতা, একে-অপরকে হুমকি-ধমকি এমনকি নিজ দলের নেতা-কর্মীদের উপর হামলা-মামলায় জড়াচ্ছেন প্রার্থী বা তার সমর্থকেরা। ১৮ মার্চ (বৃহস্পতিবার) রাতে নগরের ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে বিদ্রোহী কাউন্সিলরপ্রার্থীর এক সমর্থককে হত্যার অভিযোগ উঠেছে প্রতিপক্ষ ক্ষমতাসীন দল সমর্থিতপ্রার্থীর বিরুদ্ধে। তার মধ্যেই ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নিরবে-নিভৃতে চেষ্টা করে যাচ্ছে চসিক নির্বাচনে দলটির বিদ্রোহী প্রার্থীদের দমাতে। গত বেশ কিছুদিন ধরে ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে দলের বিদ্রোহী প্রার্থীদের সরে দাঁড়ানোর আহ্বানে সাড়া দেননি বিদ্রোহী। নগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় শৃঙ্খলা ভঙ্গে দায়ীদের বিরুদ্ধে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের হুঁশিয়ারিও কাজে আসেনি। সর্বশেষ গত কয়েকদিনে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের মাধ্যমে নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে দলীয়প্রার্থীদের পক্ষে কাজ করতে নির্দেশ দেয়া হয়। এমনকি প্রার্থীদের স্ত্রী, কন্যা, ভাই, বোন বা আত্মীয়-স্বজনদের কাছে ফোন করে তাদের নির্বাচন থেকে সরিয়ে নিতে বলা হয়। তা না হলে অনেককে তুলে নিয়ে যাওয়ারও হুমকি দেয়া হয়।
কিছুতেই যেন কাজ হচ্ছে না। সর্বশেষ বৃহস্পতিবার (১৯ মার্চ) চট্টগ্রাম নগরের দি পেনিনসুলা হোটেলে বিদ্রোহীপ্রার্থীদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক বিফলে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর সংবাদ সম্মেলন করে আ’লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। এর সমন্বয়ক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি দাবি করেছেন- বিদ্রোহী প্রার্থী এখন আর নেই। সবাই নির্বাচন থেকে সরে গিয়ে দলের প্রার্থীকে সমর্থন দিয়ে কাজ করতে সম্মত হয়েছেন। তাঁর এই বক্তব্যের পর একাধিক বিদ্রোহী তথা স্বতন্ত্র প্রার্থী বলেছেন- তারা এমন কোনো সম্মতি দেননি। তারা নির্বাচনে আছেন, থাকবেন। যদি তাদের গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে মৃত্যু ভয় দেখিয়ে তুলেও নেয়া হয় তাহলেও তাদের সমর্থকেরা তাদের পক্ষে প্রচার-প্রচারণা ও নির্বাচন পরিচালনা করে তাদের বিজয়ী করবে। বিদ্রোহীদের নিয়ে যে বৈঠকের কথা বলা হচ্ছে সেই বৈঠকেও যাননি অধিকাংশ প্রার্থী।
বিদ্রোহীদের এমন অনড় অবস্থানে বেশ চিন্তিত দলটির নির্বাচন পরিচালনা কমিটি। বৃহস্পতিবারের এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, সংসদ সদস্য এম এ লতিফ, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীন ও সহ-সভাপতি আলতাফ হোসেন চৌধুরী বাচ্চু।
বৈঠক শেষে সংবাদ সম্মেলনে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘কাউন্সিলর পদে যারা দলের মনোনয়ন পেয়েছেন তাদের বাইরেও কিছু প্রার্থী আছে। সে বিষয়ে আজকে বৈঠক করেছি। তারা একমত পোষণ করেছে যে, তারা আর প্রচারণা করবেন না। দলের প্রার্থীকে সমর্থন দেবেন এবং তাদের পক্ষে প্রচারণা চালাবেন। প্রায় সবাই একমত হয়েছেন।‘
আ জ ম নাছির উদ্দীন বলেন, ‘যেহেতু প্রার্থিতা প্রত্যাহারের সময় নেই, দল ও সভানেত্রীর প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করে ওনারা নিজেরা প্রচার প্রচারণা থেকে বিরত থাকবেন এবং আমাদের প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা চালাবেন। আর আমাদের মেয়র প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণাতে উনারা সর্বশক্তি নিয়োগ করবেন’। মেয়র বলেন, ‘এরইমধ্যে অনাকাঙ্খিত কিছু ঘটনা ঘটেছে। কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থীর মধ্যে সংঘাত হয়েছে, মামলা-পাল্টা মামলা হয়েছে। আহত হয়েছেন এমনকি গতকাল একজন নিহতও হয়েছেন। এই শঙ্কা থেকেই আমরা তাদের নিয়ে বসেছিলাম। যদি শঙ্কা না থাকতো তাহলে হয়তো এটি অন্যভাবেও হতে পারতো’।
কতজন বিদ্রোহী নির্বাচন না করার বিষয়ে একমত হয়েছেন, জানতে চাইলে আওয়ামী লীগের নেতারা কোনো উত্তর দেননি।
মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, ‘আমরা বলতে চাই তাদের সবার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার আছে। তারা নিশ্চয় নিজেদের রাজনৈতিক ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত করতে চাইবেন না। সিদ্ধান্ত নিয়েছি দলীয় শৃঙ্খলার প্রশ্নে কেউ কোনো ছাড় দেব না। প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। আশা করি সবাই দলের প্রার্থীর পক্ষে থাকবেন এবং নিজের প্রচারণা সংকুচিত করবেন। কেউ যদি সেটি না মানেন, তাহলে কিভাবে মানাতে হয় সেটা জানা আছে’।
সংবাদ সম্মেলনের পর অধিকাংশ বিদ্রোহী প্রার্থীই জানিয়েছেন, তারা বৈঠকে যাননি। নির্বাচনী মাঠেই থাকছেন সবাই। আলকরণ ওয়ার্ডের বিদ্রোহী প্রার্থী ও বর্তমান কাউন্সিলর তারেক সোলায়মান সেলিম বলেন, ‘আমার পায়ে সমস্যা, হাঁটতে পারছি না। সেজন্য বৈঠকে যাইনি। আমি নির্বাচন করব। যতই চাপ আসুক, সরবো না’।
ফিরিঙ্গিবাজার ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থী যুবলীগ নেতা হাসান মুরাদ বিপ্লব জানান, ‘আমি বৈঠকে গিয়েছিলাম মোশাররফ ভাইকে সালাম দেওয়ার জন্য। আমি নির্বাচন করবই। পেছনে যাবার কোনো সুযোগ নেই’।
এনায়েত বাজার ওয়ার্ডের প্রার্থী সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাব্বির চৌধুরী বলেন, ‘করোনাভাইরাস নিয়ে আতঙ্কে আছি। এমনিতেই প্রচার-প্রচারণা বন্ধ করে ঘরে বসে আছি। বৈঠকে যাইনি। আমি স্বতন্ত্র প্রার্থী। আমি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ফরমও কিনিনি। আমার বসে যাবার কোনো সুযোগ নেই’।
পাথরঘাটা ওয়ার্ডের অনুপ বিশ্বাস বলেন, ‘গোয়েন্দা সংস্থা ডেকেছিল, আমি যাইনি। অ্যারেস্ট করলে করবে, কিন্তু আমি নির্বাচন করব। এই মুহুর্তে সরে গেলে মানুষের কাছে বেইজ্জত হয়ে যাব। আমি তো আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই, আওয়ামী লীগের ধারে কাছেও নেই। আমাকে নিয়ে টানাটানি করছে কেন বুঝতে পারছি না’।
রামপুর ওয়ার্ডের এস এম এরশাদ উল্লাহ বলেন, ‘ফোন করেছিল। শরীরটা খুব খারাপ। সেজন্য যাইনি। আমাকে কেউ ইলেকশন থেকে সরে যেতে বলেনি। আমি ইলেকশন করবই’।
১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলরপ্রার্থী যুবলীগ নেতা মনোয়ার উল আলম চৌধুরী নোবেল বলেন, গত বেশ কিছুদিন ধরে নানামুখী চাপে রাখা হচ্ছে। গোয়েন্দা সংস্থার পরিচয়ে তুলে নিয়ে যাওয়া, গায়েব করে ফেলার ভয় দেখানো হচ্ছে। এমনকি আমার পরিবারের সদস্যদের কাছেও ফোন দেয়া হয়েছে। তবে আমি যেহেতু কাট্টলীর ছেলে, কাট্টলীবাসী আমাকে চায়। তাই আমি নির্বাচনে শেষ পর্যন্ত থাকবো। মেরে ফেললে ফেলুক।
সংরক্ষিত ৭ নম্বর ওয়ার্ডের প্রার্থী আনজুমান আরা বেগম বলেন, ‘পা মচকে গেছে। ফুলে গেছে। সেজন্য মোশাররফ ভাইয়ের বৈঠকে যেতে পারিনি। আর আমার তো সরে যাবার সুযোগ নেই। জনগণ আমার নির্বাচন করে ফেলবে। আমি প্রচারণা বন্ধ করে দিলে তারা চালাবে। আমি ভোটকেন্দ্রে না গেলেও তারা ভোট দিয়ে আমাকে জিতিয়ে আনবে’।
১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর ও বিদ্রোহী তথা স্বতন্ত্র প্রার্থী মোরশেদ আকতার চৌধুরী বলেন, গতকাল (বুধবার) আমার নির্বাচন পরিচালনাকারী গুরুত্বপূর্ণ একজনকে হত্যা করা হয়েছে আমার নির্বাচনী অফিসেই। আমি এর বিচার চাই। নির্বাচন থেকে আর সরে দাঁড়ানোর প্রশ্নই আসে না।
উল্লেখ্য, চসিক নির্বাচনে মেয়র পদে ৬ জন, সাধারণ কাউন্সিলর পদে ১৬১ জন এবং সংরক্ষিত কাউন্সিলর পদে ৫৬ জন প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সাধারণ ও সংরক্ষিত মিলিয়ে মোট ১০৭ জন প্রার্থী ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে মাঠে রয়েছেন।

ডিসি/এসআইকে/আইএস