ইসলাম শফিক, প্রধান প্রতিবেদক >>>
বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনা ভাইরাস আক্রান্ত সারা বিশ্ব। লকডাউনে লক্ষ কোটি মানুষ। এই প্রাদুর্ভাবের মধ্যেই চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। কিন্তু অব্যাহত সমালোচনা আর পরিস্থিতি বিবেচনায় শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের মাত্র কয়েকদিন আগে স্থগিত করা হয় নির্বাচন। সারাদেশে শুরু হয় অঘোষিত লকডাউনও। ফলে কর্মহীন হয়ে পড়েন লাখ লাখ মানুষ। খাদ্য সংকটে পড়েন দিনমজুর, হতদরিদ্র মানুষেরা। যারা খাদ্য সংকটে আছেন তাদের জন্য সরকার কয়েকদফা খাদ্য সহায়তা বরাদ্দ দেয়। জেলা-উপজেলা-ইউনিয়নে উপজেলা প্রশাসন, জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে এসব সহায়তা বিতরণ করা হলেও মহানগরগুলোতে তা দেয়া হচ্ছে সিটি কর্পোরেশনের মাধ্যমে। সারাদেশের মতো চট্টগ্রাম মহানগরে সরকারি এসব ত্রাণ সহায়তা বিতরণের দায়িত্ব পায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। স্বভাবতই এসব খাদ্য সহায়তা বিতরণের দায়িত্ব পাচ্ছেন ওয়ার্ড কাউন্সিলরেরা।
অন্যদিকে চসিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সমর্থন না পেয়ে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কাউন্সিলর পদে নির্বাচন করছেন চট্টগ্রামের বেশ কয়েকজন বর্তমান কাউন্সিলর। তাদের নিয়ে দলীয়ভাবে একাধিকবার বৈঠক করেও তাদের বিদ্রোহ ঠেকানো যায়নি। ফলে কঠোর হুঁশিয়ারি দিতে বাধ্য হন কেন্দ্র থেকে শুরু করে মহানগর নেতারাও। দলের কঠোর অবস্থানের ফলে দলীয় নেতা-কর্মীদের অধিকাংশই দলের সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী কাজ করা শুরু করেন। অনেকে চুপসে যান কৌশলগত কারণে। যারা বিদ্রোহী তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং ভবিষ্যত রাজনৈতিক জীবন নিয়েও হুমকি আসে।
সেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের হাতেই যখন সরকারি বরাদ্দগুলো আসছে, দলীয় খাদ্য সহায়তা কর্মসূচিও যখন সেই বিদ্রোহী প্রার্থীদের মাধ্যমে বাস্তবায়ন হচ্ছে- তখনই দলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তৃণমূল থেকে ওয়ার্ড-থানা আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে জন্ম নেয় ক্ষোভ-হতাশা। তারা বলেন, দলের সিদ্ধান্ত যারা না মেনে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছেন, চসিক নির্বাচনে দলের ক্ষতি করছেন, তাদের হাতে সরকারি এবং দলীয় নানান কার্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্ব দিয়ে পরোক্ষভাবে দলে বিভাজন ও ক্ষোভ-হতাশার জন্ম দিয়েছেন খোদ নগর নেতারাই। যেখানে দলের বিরুদ্ধ জনপ্রতিনিধি আছেন সেখানে জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এসব সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা যেতো। দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধীদলের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকারি ত্রাণ না দিয়ে দলের অন্য জনপ্রতিনিধিদের দিয়ে ত্রাণ দেয়া গেলে নগরে কেন সম্ভব নয়? এসব দল বিদ্রোহী ব্যক্তিরা (কাউন্সিলর) সরকারি ও দলীয় ত্রাণ বিতরণে ওয়ার্ড-থানা আওয়ামী লীগের কারো সাথেই যোগাযোগ পর্যন্ত করছে না, সমন্বয়তো দূরের কথা। এতে করে যারা দল সমর্থিতপ্রার্থীর পক্ষে দলের সিদ্ধান্তে কাজ করছে তাদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হচ্ছে। অন্যদিকে এসব বিদ্রোহী প্রার্থী দলের কোনো পর্যায়ের কমিটিকেই পাত্তা দিচ্ছে না। এটা এখন মান-ইজ্জতের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাধারণ ভোটারদের মধ্যেও প্রভাব ফেলছে। ফলে স্থগিত থাকা সিটি নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হবে তখন বিরূপ প্রভাব পড়বে। দলীয় নেতা-কর্মীদের মাঝেও বিভেদ সৃষ্টি হবে। এতে করে সুবিধা নেবে বিরোধী দলগুলো।
জানা গেছে, স্থগিত থাকা চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বর্তমান কাউন্সিলর যারা দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে নির্বাচন করছেন তারা হচ্ছেন নগরের ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডে তৌফিক আহমেদ চৌধুরী, ২ নম্বর জালালাবাদ ওয়ার্ডে সাহেদ ইকবাল বাবু, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে জহুরুল আলম জসিম, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে মোরশেদ আক্তার চৌধুরী, ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডে সাবের আহমেদ সওদাগর, ১৪ নম্বর লালখান বাজার ওয়ার্ডে এফ কবির আহমেদ মানিক, ২৫ নম্বর রামপুর ওয়ার্ডে এসএম এরশাদ উল্লাহ, ২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদ ওয়ার্ডে এইচএম সোহেল, ২৮ নম্বর পাঠানটুলী ওয়ার্ডে আব্দুল কাদের, ৩১ নম্বর আলকরণ ওয়ার্ডে তারেক সোলায়মান সেলিম, ৩৩ নম্বর ফরিঙ্গিীবাজার ওয়ার্ডে হাসান মুরাদ বিপ্লব এবং ৩০ নম্বর পূর্ব মাদারবাড়ি ওয়ার্ডে মাজহারুল ইসলাম চৌধুরী। এছাড়াও ৯, ১০ ও ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে আবিদা আজাদ, ১৬, ২০ ও ৩২ নম্বর ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর আনজুমানা আরা বেগম, ১২, ২৩ ও ২৪ নম্বর সংরক্ষিত ওয়ার্ড থেকে ফারহানা জাভেদ, ২৮, ২৯ ও ৩৬ নম্বর ওয়ার্ড থেকে নির্বাচনে থেকে গেছেন ফেরদৌসী আকবর। তবে প্রথম দিকে ৭ ও ৮ নম্বর ওয়ার্ডে মহিলা আওয়ামী লীগের ৪২ নং সাংগঠনিক ওয়ার্ড সভাপতি জোহরা বেগম মনোনয়ন পাওয়ায় সেখানে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নির্বাচনে থেকে যান বর্তমান কাউন্সিলর জেসমীন পারভিন জেসী। পরে অবশ্য জোহরা বেগমের মনোনয়নপত্র বাতিল করে নির্বাচন কমিশন। পরে জেসমিন পারভীন জেসি আওয়ামী লীগের সমর্থন পান। গত ১৯ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের স্থানীয় সরকার মনোনয়ন বোর্ড চট্টগ্রাম সিটি নির্বাচনে দল সমর্থিত প্রার্থীদের নাম ঘোষণা করে। এতে বাদ পড়েন এই ১২ কাউন্সিলর। এদের মধ্যে চারবারের হেভিওয়েট কাউন্সিলরও যেমন ছিল, তেমনি ছিল নবীন কাউন্সিলরও। তাদের এই বিদ্রোহের আগুনে দলটির বেশকিছু নেতা-কর্মী হত্যাকাণ্ডের শিকারও হয়েছেন। নির্বাচনী প্রচারের সময় হামলা-পাল্টা হামলায় অনেকে গুরুতর আহতও হয়েছেন। এখনো অনেকে চিকিৎসাধীন।
১, ২, ৯, ১১, ১২, ১৪, ২৫, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১ ও ৩৩ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগদলীয় নেতা-কর্মীরা জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে বিরোধী দলের অনেক জনপ্রতিনিধিও আছেন। অনেক স্থানে সেসব জনপ্রতিনিধিদের এড়িয়ে দলীয় জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে কিংবা প্রশাসনের মাধ্যমে সরকারি ত্রাণ সহায়তাসহ অন্যান্য সরকারি তহবিল জনগণের মধ্যে বিতরণ করার উদাহরণ আছে। তাদের যদি বাদ দিয়ে সরকারি ত্রাণ বিতরণ সম্ভব হয়, তাহলে নগরের কাউন্সিলর যারা আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও নগর কমিটির সিদ্ধান্ত না মেনে বিদ্রোহী হিসেবে নির্বাচন করছে, দলের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছে- তাদের কেন সরকারি ত্রাণ বরাদ্দ দেয়া হচ্ছে? এসব বিদ্রোহী কাউন্সিলরপ্রার্থীরা ওয়ার্ডে দলের যে কমিটি তাদের কাউকেই সমন্বয় কিংবা সম্পৃক্ত করছে না। নিজেদের ইচ্ছেমাফিক নিজেদের সমর্থক নেতা-কর্মী ও ব্যক্তিদের মাঝে সরকারি এসব ত্রাণ ও অন্যান্য সহায়তা বিতরণ করছে। এতে করে দলের সিদ্ধান্ত অনুসারে দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে যারা অবস্থান নিয়েছেন, তাদের মধ্যে ক্ষোভ, হতাশা এবং দলীয় বিভাজনের সৃষ্টি হচ্ছে। এসব বিদ্রোহী কাউন্সিলরপ্রার্থীরা দলীয় নেতৃবৃন্দকে কোনো ধরণের তোয়াক্কাই করছে না। বরং তারা প্রথম ৫ দফায় সরকারের বরাদ্দকৃত ত্রাণ নিজেদের নামে চালিয়েছে। এ নিয়ে যখন সমালোচনা সৃষ্টি হয়েছে তখন ত্রাণের বস্তায় সরকারি নির্দেশনা অনুসারে ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার’ লেখার নির্দেশা জারি হয়। কিন্তু নির্দেশনা থাকলেও, বাস্তবিক অর্থে সরকারি এসব সহায়তা নিয়ে বিদ্রোহীরা রাজনীতি করছেন। এতে দলের তৃণমূল নেতা-কর্মীরা দল সমর্থিত প্রার্থীর পক্ষে কাজ করতে অনুৎসাহিত হচ্ছেন। দলে বিভাজন ও গ্রুপিং এর সৃষ্টি হচ্ছে। আর এই ক্ষোভ, বিভাজন এবং হতাশা চসিক নির্বাচনে বড় ধরণের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। দলীয়প্রার্থীরা দলের শীর্ষ নেতৃত্বের এমন দ্বিমুখী আচরণে মনোবল হারাতে পারেন।
দল সমর্থিত একাধিক কাউন্সিলরপ্রার্থীরা দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, যেখানে দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কিছু কাউন্সিলর দলের ক্ষতিতে লিপ্ত, তাদের হাতে সরকারি সহায়তা যাওয়ায় তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মাঝে ক্ষোভ, বিভাজন এবং হতাশা বিরাজ করছে। সরকারি এসব ত্রাণ বিতরণে ওয়ার্ড-থানা কমিটির সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে পর্যন্ত সম্পৃক্ত করা হচ্ছে না। তাদের একক সিদ্ধান্তে সরকারি ত্রাণ বিতরণ করায় সমালোচনার সৃষ্টি হচ্ছে। দলের ও সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। এসব বিদ্রোহী কাউন্সিলরপ্রার্থীরা তাদের সমর্থক নেতা-কর্মীদের মাঝে এসব ত্রাণ সহায়তা দেয়ায় প্রকৃত কষ্টে থাকা সাধারণ মানুষ বঞ্চিত হচ্ছেন। তারা সরকারের ত্রাণকে নিজেদের ক্রেডিট হিসেবে ভোটের রাজনীতিতে ব্যবহার করছে। তবে, আমরা দলীয়প্রার্থী যারা নির্বাচন করছি তারা তাদের ব্যক্তিগত সামর্থের যতটুকু সম্ভব তা নিয়ে মানুষের ঘরে ঘরে যাচ্ছি। আমাদের নিজেদের ত্রাণ ও অন্যান্য সহায়তা ও কার্যক্রম দল ও সরকারের নামে বিতরণ করছি। কিন্তু সেখানে গিয়ে আমরা সাধারণ ভোটারদের কাছে হেনস্থা হচ্ছি, তাদের অনেক যৌক্তির প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে হিমশিম খাচ্ছি।
এ প্রসঙ্গে ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ দলীয় কাউন্সিলরপ্রার্থী এবং দলটির ওয়ার্ড কমিটির আহ্বায়ক আলহাজ্ব মো. নুরুল আমিন দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সরকারি এসব ত্রাণ বিতরণের নিয়ম থাকায় সরকারি বরাদ্দ তাদের হাতেই আসছে। কিন্তু এসব সরকারি বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে দলের ওয়ার্ড-থানা কমিটিকে সম্পৃক্ত করে, দলীয়প্রার্থীদের সাথে সমন্বয় করে বিতরণ করার দলীয় নির্দেশনা থাকলেও তা মানছেন না ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে নির্বাচন করা প্রার্থী। আমার ওয়ার্ডেও একই অবস্থা। তারা সরকারি বরাদ্দ নিয়ে ভোটের রাজনীতি করছেন। তাদের সমর্থক নেতা-কর্মীদের মধ্যে এবং তাদের মাধ্যমে সরকারি বরাদ্দ, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার উপহারকে নিজেদের নামে বিতরণ করছে। এতে করে দলীয় নেতা-কর্মীরা বিভাজনে পতিত হচ্ছেন। অন্যদিকে প্রকৃত কষ্টে থাকা সাধারণ মানুষ সরকারি বরাদ্দ ও প্রধানমন্ত্রীর উপহার পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। জনমনে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দল সমর্থিত কাউন্সিলরপ্রার্থী অধ্যাপক মো. ইসমাইল দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, আমার ওয়ার্ডের বর্তমান কাউন্সিলর (মোরশেদ আক্তার চৌধুরী) দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। তিনি বিএনপির নোমান সাহেবের প্রার্থী বলেও প্রচার আছে এলাকায়। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কারো সাথেই তার কোনো সম্পর্ক নেই। যারা দলের সিদ্ধান্ত না মেনে বিরুদ্ধে গেছে, তাদেরকে দিয়েই সরকারি সকল বরাদ্দ, নগর পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের খাদ্য সহায়তা বিতরণ করা হচ্ছে। এটাতো স্ববিরোধী কর্মকাণ্ড। আর সরকারি যেসব সাহায্য-সহযোগিতা আসছে তা কিন্তু আওয়ামী লীগের ত্যাগি ও দরিদ্র নেতা-কর্মীরা পাচ্ছে না, পাচ্ছে শুধু বিদ্রোহী কাউন্সিলরপ্রার্থীর সমর্থক ও বিএনপির লোকজন। প্রকৃত কষ্টে থাকা সাধারণ মানুষ এসব বরাদ্দ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। দলীয়প্রার্থী হিসেবে তারা আমাকে প্রশ্নবানে জর্জরিত করছেন। তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এসব সরকারি খাদ্য সহায়তা বিতরণে সমন্বয় সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে দক্ষিণ কাট্টলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগকে অবগত করা হয়নি এবং জানানোও হয়নি। কেউ আমাদের সাথে এখনো এই বিষয়ে যোগাযোগ করেনি। তবে দলের বিরুদ্ধে যাওয়া ব্যক্তি যখন সরকারের জনমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়নের সুযোগ পায়, স্বাভাবিকভাবেই দলের নেতা-কর্মীদের মাঝে বিভাজন সৃষ্টি হয়। ক্ষোভ-হতাশাও সৃষ্টি হয়। এতে দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্নের পাশাপাশি দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্যকে প্রভাবিত করে। তিনি বলেন, দলের ত্যাগী নেতা-কর্মীরা আমাদের কাছে রেশন কার্ড, ত্রাণ সহায়তা চাচ্ছেন। আমরা এর কোনো জবাব দিতে পারি না। আমি আমার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ওয়ার্ডের ১০ হাজার পরিবারে খাদ্য সহায়তা দিয়ে পাশে থাকার চেষ্টা করেছি।
৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে দল সমর্থিক কাউন্সিলরপ্রার্থী ও পাহাড়তলী থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি মো. নুরুল আবছার মিয়া দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়া, দলের নেতা-কর্মীদের সাথে সম্পর্ক না রাখা, দলে বিভাজন সৃষ্টিকারীদের হাতে সরকারি খাদ্য সহায়তা আসায় ওয়ার্ডে নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হচ্ছে। বিভাজন তৈরি হচ্ছে। আমি দলের প্রার্থী এবং থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবেও সরকারি খাদ্য সহায়তা ও বিতরণ ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে অবগত নই। প্রকৃত অভাবগ্রস্ত মানুষদের এসব সরকারি সহায়তা না দিয়ে কাউন্সিলর নিজের অনুসারিদের মধ্যে এসব বিতরণ করার অভিযোগ আমাদের কাছে অসংখ্যজন করছেন। আমিও এটি পর্যবেক্ষণ করেছি। সরকারি বরাদ্দ নিয়ে ভোটের রাজনীতি করছেন দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করা কাউন্সিলরর। আমার থানা কমিটির আওতায় ৯ ও ১২ নম্বর ওয়ার্ড দু’টি অবস্থিত। এই দু’টি ওয়ার্ডেই বর্তমান কাউন্সিলর দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে বিদ্রোহী হয়ে নির্বাচন করছে। তারা দু’জনই থানা ও ওয়ার্ড আ’লীগের কমিটি কিংবা সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে সমন্বয়তো দূরের কথা, কোনো তোয়াক্কাই করছে না। আমরা দলীয় ফোরামকে বিষয়টি অবহিত করেছি।
আকবরশাহ থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কাজী আলতাফ হোসেন দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, আমাদের থানা কমিটির আওতায় ২ টি ওয়ার্ড রয়েছে। একটি ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী এবং ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী। উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ওয়ার্ড-থানা কমিটির সাথে সমন্বয় করে সরকারি ও তার ব্যক্তিগত বরাদ্দ বিতরণ করলেও উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে তা হচ্ছে না। এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ওয়ার্ড-থানা কমিটির সাথে কোনো সমন্বয় করছেন না। তিনি বলেন, একেতো সে দলের বিরুদ্ধে গিয়ে নির্বাচন করছে। অন্যদিকে ওয়ার্ডে সরকারি কিংবা দলের যে ত্রাণ সহায়তা কার্যক্রম তা নিয়ে ওয়ার্ড কিংবা থানা কমিটির সাথে কোনো ধরণের সমন্বয় সে করছে না। তিনি বলেন, ওয়ার্ডে এমনও মানুষ আছেন যার চুলায় পানি আছে, কিন্তু তাতে চাউল নেই। তারা একবারও ত্রাণ পায়নি। কিন্তু জসিমের অনুসারি হওয়ায় একজনই একাধিকবার ত্রাণ পেয়েছে যা দুঃখজনক। সরকারি ও বেসরকারি সব ত্রাণই জসিম তার অনুসারিদের মধ্যে বিতরণ করেছে। করোনা মোকাবেলায় অন্যান্য সব ওয়ার্ডে দলের ওয়ার্ড-থানা পর্যায়ের নেতাদের সাথে নিয়ে কার্যক্রম পরিচালিত হলেও উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ডে হচ্ছে না। এমনকি নগর নেতৃবৃন্দ দলের নেতাদের সাথে সমন্বয় করার নির্দেশনা দিলেও তা মানেনি জসিম।
তবে চসিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের সমর্থন না পাওয়া একাধিক কাউন্সিলর দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেছেন, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে আমরা সরকারি বরাদ্দ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব পালন করছি। নিজেদের অনুসারিদের মধ্যে কিংবা নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে এসব করার বিন্দুমাত্র চিন্তা আমাদের কারোই নেই। ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলী ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও দলের বিদ্রোহী প্রার্থী মো. জহুরুল আলম জসিম দৈনিক চট্টগ্রামকে জানিয়েছিলেন, ‘আমি সবাইকেই ফোন করে জানিয়েছি। তারা যদি কাউন্সিলর কার্যালয়ে না আসেন আমারতো কিছু করার নেই। তিনি বলেন, থানা আওয়ামী লীগের সাথে সরকারি বা বেসরকারি ত্রাণ সহায়তা নিয়ে কেন সমন্বয় করতে হবে? থানা আওয়ামী লীগতো এখানে কিছু না। তিনি বলেন, আমি আহ্বায়ক এসএম আলমগীর সাহেব, যুগ্ম আহ্বায়ক মামুনকে ডাকছি। তারা না আসলেতো আমি জোর করে আনব না। আর উনারা যদি কাউন্সিলর অফিসে না আসেন তাহলে আলোচনা কেমনে করবো। আর ত্রাণতো দলীয়ভাবে না, ত্রাণতো দলীয়ভাবে হয় না। এগুলো সরকারি ত্রাণ। আর সরকারি ত্রাণে দলীয় নেতাদের সম্পৃক্ত না করার জন্য সরকারের নির্দেশ আছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে জসিম বলেন, উনাদের ত্রাণ কমিটিতে রাখছি, উনাদের জানানো হইছে, ফেসবুকেও তালিকা দিছি। আহ্বায়কদের তিনজনকেই কমিটিতে রাখছি, মেয়র সাহেব উনাদের রাখতে বলছেন। কিন্তু উনারা না আসলেতো আমার কিছু করার নাই। কথা শেষে ফোন কেটে দিলে কাউন্সিলর আবারো ফোন করে দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, আমি ত্রাণ নিয়ে সমন্বয় না করলে ওয়ার্ড কমিটির আহ্বায়ক আলমগীর সাহেব মানুষ পাঠিয়ে ৭ পরিবারের ত্রাণ কিভাবে নিলেন? তিনি বলেন, থানা আওয়ামী লীগের আলতাফ সাহেবকেওতো আমি আসতে বলছি। উনি আমাকে বলছেন- আমি ঘর থেকে বের হই না। আমি বুড়া মানুষ। জসিম বলেন, মেয়র সাহেব যেভাবে বলছেন আমি সেভাবেই কাজ করছি।
৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গী বাজার ওয়ার্ড কাউন্সিলর হাসান মুরাদ বিপ্লব দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, সরকারি বরাদ্দ নিয়ে ভোটের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। আর সরকারি বরাদ্দ নিজের নামে চালিয়ে দেয়ারও সুযোগ নেই। আমার ব্যক্তিগত মতামত হচ্ছে- এ পর্যন্ত ত্রাণ বিতরণে আমি স্বেচ্ছাচারিতা করেছি, কিংবা আমার ওয়ার্ডের দলীয় নেতা-কর্মীদের সাথে সমন্বয় করিনি- এটা হয়নি। এটা আমার মনে ধারণও করিনি। আমি সবার সাথে সমন্বয় করে সরকারি সহায়তা ঘরে ঘরে পৌঁছে দিচ্ছি। এখন আমার একমাত্র কাজই হচ্ছে- আমার ওয়ার্ডকে করোনা থেকে সুরক্ষিত রাখা। এখানকার কেউ যাতে কষ্টে না থাকে সেদিকে নজর রাখা। এই মুহুর্তে নির্বাচন-রাজনীতি- এসব করার সুযোগ নেই।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছির উদ্দীনের মোবাইল নাম্বারে একাধিববার ফোন করেও তিনি ফোন রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
তবে নগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি খোরশেদ আলম সুজন দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, সরকারি বরাদ্দ নিয়ে ভোটের রাজনীতি, চসিক নির্বাচনে যারা দলের বিদ্রোহী কাউন্সিলরপ্রার্থী তারা ওয়ার্ড-থানা কমিটির, সিনিয়র নেতৃবৃন্দের সাথে সমন্বয় (কিছু কিছু ওয়ার্ডে হচ্ছে) করছেন না- এমন অভিযোগ আমরা পেয়েছি। এটা ঠিক হয়নি, হচ্ছে না। এটার জন্য চরম মূল্য সংশ্লিষ্টদের দিতে হবে। দলের সিনিয়র নেতৃবৃন্দকে অসম্মান করা কোনোভাবেই বরদাশ্ত করা হবে না। তিনি বলেন, এখন সরকার মানুষের প্রাণ বাঁচাতে যেমন মরিয়া, অর্থনৈতিক চাকাকে সচল রাখতেও মরিয়া। এই সময়ে যারা সরকারি ত্রাণ নিয়ে নোংরামি করছেন, ভোটের রাজনীতি করছেন, দলে বিভাজন তৈরি করছেন তাদের ব্যাপারে দল ওয়াকিবহাল। এসব ঘটনা চট্টগ্রামে ঘটছে। চসিক নির্বাচন সংক্রান্ত বিষয়ে আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটি আছে। তারা এসব বিষয়ে অবগত। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে এবং নির্বাচন তারিখ ঘোষণার আগেই এই বিষয়ে দলীয় মনোভাব দেখতে পাবেন।
ডিসি/এসআইকে/আইএস