কাউন্সিলরপ্রার্থী ওয়াসিমের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ থানা-ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতাদের, কেন্দ্রে চিঠি

ওয়াসিম উদ্দীন চৌধুরী।

নগর প্রতিবেদক >>>
আসন্ন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রতিদিনই সরগরম হয়ে উঠছে চট্টগ্রাম। ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডে মিথ্যা তথ্য দিয়ে এবং তৃণমূল নেতা-কর্মী, ওয়ার্ড-থানা আওয়ামী লীগের বিদ্যমান কমিটির নেতৃবৃন্দের সম্মতি, মতামত কিংবা ইচ্ছা-অনিচ্ছাকে প্রাধান্য না দিয়ে প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করায় মাঠ পর্যায়ে চরম অসন্তোষ ছড়িয়ে পড়েছে। ইতোমধ্যে চট্টগ্রাম নগরীর ১৪ নম্বর লালখান বাজার, ১৬ নম্বর চকবাজার ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ সংবাদ সম্মেলন করেছে। বিশেষ বর্ধিত সভা করে প্রার্থীর বিরুদ্ধে সরব হয়েছেন তারা। সর্বশেষ সোমবার (২৪ ফেব্রুয়ারি) চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় উপস্থিত একাধিক আওয়ামী লীগ নেতা ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরীর বিরুদ্ধে নানান অপরাধে যুক্ত থাকা, পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া নিয়ে উচ্চবাচ্য করেছেন। তারা প্রকাশ্যেই দলীয় কাউন্সিলরপ্রার্থীর নানান অপকর্ম তুলে ধরে বক্তব্য দিয়েছেন সভার আগে-পরে। শুধু তাই নয়, ১১, ১২, ১৩, ২৫, ২৬, ৮, ১৪ নম্বর লালখান বাজার নিয়ে গঠিত সংসদীয় আসনের এমপি ডা. আফছারুল আমিনের বিরুদ্ধেও প্রকাশ্য বক্তব্য দিয়েছেন অনেকেই। তাদের মধ্যে ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যুগ্ম আহ্বায়ক ও বর্তমান কাউন্সিলর সরাসরি এমপির নানান গ্রুপিং কর্মকাণ্ড নিয়ে যেখানেই সুযোগ পাচ্ছেন সেখানেই বলেছেন তীব্র তিক্ততার কথা। প্রার্থী পরিবর্তন না হলে ওয়ার্ডে একাধিক প্রার্থী নির্বাচন করার বিষয়টিও তুলে ধরেন সভায় উপস্থিত নেতারা। এর প্রেক্ষাপটে নির্বাচনে দলের সমন্বয়কের দায়িত্ব পাওয়া ইঞ্জিনিয়ার মোশারফ হোসেন কঠোর হুৃঁশিয়ারি দেন বিদ্রোহী প্রার্থীদের।
এছাড়াও গত ২৩ ফেব্রুয়ারি (রবিবার) ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া এবং সাধারণ সম্পাদক কায়সার মালিক দলীয় মনোনয়ন পুন:বিবেচনার আবেদন জানিয়ে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক বরাবরে চিঠি দিয়েছেন। চিঠিতে উল্লেখ করা হয়, ‘আসন্ন নির্বাচনে দলীয় মনোনীত প্রার্থীর বিষয়ে ইতোমধ্যে সাধারণ ভোটারদের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। দলীয় মনোনয়ন প্রাপ্ত প্রার্থী ইতোমধ্যে বহিরাগত লোকজন নিয়ে হোন্ডাবহর করার পাশাপাশি সাধারণ লোকজন এমনকি দলীয় লোকজনকে হুমকি-ধমকি প্রদর্শন এবং ২২ ফেব্রুয়ারি ২০২০ইং তারিখে বেশ কয়েকটি দোকানে হামলা-ভাঙচুর এবং ৪ জনকে পিটিয়ে রক্তাক্ত জখম করেছে, যারা বর্তমানে চমেক হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আছে। আরো উল্লেখ্য যে, দলীয় মনোনয়নপ্রাপ্ত প্রার্থীর অতীত, বর্তমান কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও অত্র ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও ভোটারগণের বিরূপ ধারণা রহিয়াছে। এমতাবস্থায় দলীয় তদন্তপূর্বক অত্র ওয়ার্ডের প্রার্থী মনোনয়ন পুনঃবিবেচনা করার জন্য জোর দাবি সমেত আবেদন করছি’।
চিঠির বক্তব্যের বিষয়ে খোলাসা করে জানতে চাইলে ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ ভূঁইয়া ও সাধারণ সম্পাদক কায়সার মালিক দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, ‘আমাদের এলাকার প্রতিটা মানুষ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের প্রতিটি কর্মী-সমর্থক, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ সর্বোপরি এই অঞ্চলের সকল শ্রেণি-পেশার মানুষ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা জানেন দলীয় মনোনয়ন পাওয়া ওয়াসিম উদ্দীন একজন পতিতা ব্যবসায়ী, মাদক ব্যবসায়ী ও পৃষ্ঠপোষক, সন্ত্রাসী বাহিনীর গডফাদার, ভূমি দস্যু এবং চট্টগ্রামের খুলশী-আকবরশাহ, পাহাড়তলী, পাঁচলাইশের বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাং পরিচালনাকারী। সে কন্ট্রাকে মাস্তানী করার পাশাপাশি চাঁদাবাজি করাই তার প্রধান পেশা। খুলশী ও পাহাড়তলীর প্রতিটি মানুষ জানেন সে এসব অপরাধে পুরোপুরি যুক্ত। খুলশী-ফয়’স লেক এলাকার যে ক’টি অসামাজিক কর্মকাণ্ডের হোটেল-গেস্ট হাউজ আছে সেগুলোর পার্টনার ও উদ্যোক্তা। এই ধরণের একজনকে কাউন্সিলরের মতো সম্মানিত, জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে দলীয় সমর্থন দেয়া কোনোভাবেই কাম্য নয়। এমন লোক যদি জনপ্রতিনিধি হয় মানুষ আর ভোট দিতেই যাবে না। কোনো নারী ও উঠতি কিশোর-তরুণ নিরাপদ থাকবে না। সুতরাং এমন প্রমাণিত প্রশ্নবিদ্ধ লোককে দলীয় মনোনয়ন না দিয়ে সাধারণ একজন তৃণমূল কর্মীকেও যদি দল মনোনয়ন দেয় তাহলে আমরা তার পক্ষেই কাজ করবো। ওয়ার্ডে তার মতো প্রশ্নবিদ্ধ চিহ্নিত সন্ত্রাসী দলীয় সমর্থনে নির্বাচন করলে ওয়ার্ডের অনেক কর্মী প্রার্থী হবেন। এটিকে নিয়ন্ত্রণ করাও আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। এতে বিরোধীপক্ষ সুযোগ পাবে, সাধারণ মানুষ আওয়ামী লীগের উপর আস্থা রাখবে না, আমরাও মুখ দেখাতে পারবো না’।
এছাড়াও ওয়ার্ড ও থানা কমিটির সবাই দলীয় মনোনয়ন পাওয়া ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরীর নানান অপকর্ম তুলে ধরে দলীয় সভাগুলোতে বক্তব্য রাখেন। তারা বলেন, একজন পতিতা ব্যবসায়ী, মাদক ব্যবসায়ী, সন্ত্রাসী ও কিশোর গ্যাং সহ এলাকার তরুণ যুব সমাজকে অপরাধে যুক্তকারী অপরাধীকে কোনোভাবেই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ, এর অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠন, তৃণমূল কোনো নেতা বা কর্মী মেনে নিবে না। এরপরেও যদি এই লোককে দল সমর্থন করে তাহলে আমরা আমাদের দলের যারা নির্বাচন করবেন তার জন্য কাজ করবো। সে এখনো নির্বাচিত হয়নি। এখনই সে বহিরাগত ছেলেদের দিয়ে মোটরসাইকেল শো-ডাউন করেছে। তার বিরুদ্ধে থাকার অপরাধে আমাদের কর্মীদের মেরে রক্তাক্ত করেছে। তাদের দোকানপাট ভাঙচুর করে ভয় দেখিয়েছে যাতে তার পক্ষে কাজ করে। এমনকি 8 বছরের ছোট্ট একটি শিশুকে আছড়ে মেরে তার মারাত্মক আহত করেছে। তারা এখন চিকিৎসাধীন। এমন লোক দলের সমর্থনে নির্বাচিত হলে সাধারণ মানুষের কাছে আমরা মুখ দেখাতে পারবো না।
এই বিষয়ে খুলশী থানা আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক ও বর্তমান কাউন্সিলর মোহাম্মদ হোসেন হিরণ দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, দল যাকেই মনোনয়ন দিবে আমি তার জন্য কাজ করবো। জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের দায়িত্ব সাধারণ ভোটারের। তাদের ভোটে কেউ নির্বাচিত হলে কোনো কথা নেই। আমিও একজন কর্মী। তাই দলের প্রতি আমার আনুগত্য রয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের বিষয়ে কোনো কথা বলতে পারি না। এটা আমার এখতিয়ার না। তবে উঠে আসা অভিযোগগুলো আপনি যেমন জানতে পারছেন, আমিও এলাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে বলেন, আর বাসিন্দা বলেন, আমিও জানি। কিন্তু দলের মতের বাইরেতো আমি যেতে পারি না। তিনি বলেন, যে কোনো প্রার্থী নির্বাচনে স্থানীয় দলীয় কমিটিগুলোর নেতৃবৃন্দের মতামতের ভিত্তিতে হওয়া উচিৎ। তাদের মতামত না নিয়ে প্রার্থী দিলে ফলাফল বিপরীত হতে পারে। আমার দলের প্রতি আমাদের সম্পূর্ণ আস্থা আছে। দেখা যাক শেষ পর্যন্ত কি হয়।
জানা গেছে, শেষ পর্যন্ত ওয়াসিম উদ্দীন চৌধুরীকে দেয়া দলীয় সমর্থন প্রত্যাহার করা না হলে নির্বাচন করবেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কায়সার মালিক, তরুণ ব্যবসায়ী মাহমুদুর রহমান এবং ঝাউতলা বাজার কমিটির সাবেক সভাপতি এম এ মতিনসহ আরো কয়েকজন। আর যদি ওয়ার্ড-থানা আওয়ামী লীগের সমর্থনে দলীয় প্রার্থী দেয়া হয় তাহলে কেউই নির্বাচন করবেন না। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে দলীয় প্রার্থীর পক্ষে কাজ করবেন।
দলটির তৃণমূল নেতা-কর্মীরা জানান, ওয়াসিম উদ্দীন চৌধুরীর বিপক্ষে খুলশী থানা ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ। তারা জানান, ওয়াসিম চিহ্নিত সন্ত্রাসী। এলাকার সবাই জানে সে কি কি অপরাধের সাথে যুক্ত। তাই তার ব্যাপারে কেউই একমত নয়। এখানে বর্তমান কাউন্সিলর কিংবা পদ-পদবীবিহীন দলের যে কোনো পরিচ্ছন্ন কর্মীকেও যদি মনোনয়ন দেয়া হয় তাহলে সবাই ঐক্যবদ্ধভাবে তাকে বিজয়ী করে মাননীয় নেত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে উপহার দিবো। ওয়াসিমকে পরিবর্তন না করলে এখানে ফলাফল বিরোধীদের দিকে যেতে পারে। তার বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনও হতে পারে বলে আমরা জানতে পেরেছি।
অভিযোগ সম্পর্কে দলীয় সমর্থনপ্রাপ্ত কাউন্সিলরপ্রার্থী মো. ওয়াসিম উদ্দীন চৌধুরী দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, আমাকে দলের প্রার্থী করেছেন আমার দলের সর্বোচ্চ নেতা জননেত্রী শেখ হাসিনা। ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের কারও কথা যে সঠিক হয়ে যাবে তা নয়। আমার অতীত কর্মকাণ্ড সম্পর্কে নিশ্চই আমার দলের নেত্রী খবরাখবর নিয়েছেন। তিনি বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী/এজেন্সি- সব প্রতিবেদন দেখেইতো আমাকে সমর্থন দিয়েছেন। সুতরাং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের যারা আমার বিরুদ্ধে নানান রকম অভিযোগ করছে তাতে আমার কিছু যায় আসে না। ওয়ার্ডে দলের সাধারণ সম্পাদক কায়সার মালিকও কাউন্সিলর প্রার্থী ছিলেন। তিনি নেত্রীর সমর্থন না পেয়ে যদি মনঃক্ষুন্ন হন তাতেতো আমার কিছুই করার নেই। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি মাদক, সন্ত্রাস, চাঁদাবাজি কিংবা পতিতা ব্যবসা- এগুলোর সাথে কখনোই জড়িত ছিলাম না। দলীয় সমর্থন না পেয়ে আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটানো হচ্ছে। আরেক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাকে মনোনয়ন দিয়েছেন স্বয়ং নেত্রী। ওয়ার্ড, থানা বা নগর আওয়ামী লীগের সভায় আমাকে নিয়ে কে কি বললো তাতে আমার কিছু যায় আসে না।

ডিসি/এসআইকে/এসজেপি