সরে দাঁড়াতে কঠোর হুঁশিয়ারি মোশাররফের, অনড় বিদ্রোহীরা অপেক্ষায় ৮ মার্চের

ইসলাম শফিক, প্রধান প্রতিবেদক >>>
আসন্ন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়া নেতাদের প্রার্থীতা প্রত্যাহার করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তা না হলে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নির্বাচন সমন্বয়কারী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন। দল ও দলীয় শৃঙ্খলার স্বার্থে বিদ্রোহী প্রার্থীদের সরে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির প্রধান সমন্বয়ক ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনসহ নেতারা বলেন, যারা আওয়ামী লীগ করেন তারা নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াবেন। না হলে দলীয় প্রধানের নির্দেশনা অনুযায়ী তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন এমপি।

বৃহস্পতিবার (৫ মার্চ) দুপুরে চট্টগ্রাম নগরের থিয়েটার ইনস্টিটিউটে অনুষ্ঠিত দলটির সমর্থন পাওয়া এবং সমর্থনবঞ্চিত কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার এই বৈঠকে চসিক নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচন পরিচালনা কমিটির পক্ষ থেকে এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এর আগে সকাল ১০টা থেকে দলের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের নিয়ে আওয়ামী লীগের নির্বাচন সমন্বয় কমিটি বৈঠক শুরু করে। বৈঠক শেষ হয় বেলা ২ টার দিকে।
বৈঠকে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন ছাড়াও অংশ নেন চট্টগ্রাম মহানগর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি মাহতাব উদ্দিন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ও সিটি মেয়র আ জ ম নাছির, সংসদ সদস্য এম এ লতিফ, নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য সচিব অ্যাডভোকেট ইব্রাহীম হোসেন চৌধুরী বাবুলসহ সিনিয়র নেতৃবৃন্দ।
বৈঠকে অংশ নেয়া প্রতিটি ওয়ার্ডের বিদ্রোহী প্রার্থীদের দলীয় পরিচয়সহ বিভিন্ন বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। তবে কোনো প্রার্থীকেই নিজস্ব মতামত তুলে ধরে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ দেয়া হয়নি। ফলে বিদ্রোহী প্রার্থীদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং তারা সভা শেষে বাইরে বিক্ষোভ দেখান।
এর আগে নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সমন্বয়ক ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জানিয়েছিলেন, এই বৈঠকের মাধ্যমে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীদের সরানো না গেলে আগামি ৮ মার্চ (রবিবার) বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে কঠোর সিদ্ধান্ত নেবেন দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
বৈঠকে উপস্থিত ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডে দলীয় কাউন্সিলরপ্রার্থী আলহাজ্ব মো. নুরুল আমীনসগ বেশ কয়েকজন কাউন্সিলর প্রার্থী দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, ‘সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে আয়োজিত এ বৈঠকে দলের বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীরা ‘ফিল্ড ওপেন’ বা নির্বাচনে সমর্থন তুলে নিয়ে উন্মুক্ত করে দেয়ার অনুরোধ জানান। তবে তাদের এ অনুরোধ নাকচ করে দিয়ে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, চসিক নির্বাচনে যারা দলের সমর্থন পেয়েছেন, তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। দলের হাই কমান্ডের দেওয়া এ সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়ার সুযোগ কারও নেই। তিনি আরও বলেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কেউ কাউন্সিলর নির্বাচন করলে এর ফল ভালো হবে না। দলীয় কোনো সহযোগিতা তারা পাবেন না। বরং তাদের বিষয়ে কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে’।
তিনি আরো জানান, ‘বিদ্রোহী প্রার্থীদের মনোনয়ন প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়ে নির্বাচন সমন্বয়ক মোশাররফ হোসেন বলেন, আমরা সবাই জানি, দলে আপনাদের অবদান রয়েছে। দলের জন্য অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছেন আপনারা। তবে সবার উপরে দল। দলের সিদ্ধান্ত সবাইকে মানতে হবে। দলের জন্য কাজ করেও বঙ্গবন্ধুর সময়ে আমি মনোনয়ন পাইনি। এরপর ৪-৫ বার আমি এমপি-মন্ত্রী হয়েছি। এখন আমার মন্ত্রীত্ব নেই। এজন্য কি আমি দল ছেড়ে দিয়েছি? দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে কিছু করেছি?’
দুই পর্বের এ বৈঠকের শেষ পর্যায়ে বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীরা নিজেদের বক্তব্য উপস্থাপনের সুযোগ চান। তবে তাদের সুযোগ না দিয়ে আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বলেন, ৮ মার্চ আইসিসি কনভেনশন সেন্টারে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের নিয়ে আয়োজিত সমাবেশে দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের আসবেন। আপনাদের কোনো বক্তব্য থাকলে তার কাছেই বলতে পারবেন। বক্তব্য দিতে না দেওয়ায় এ সময় ক্ষোভ প্রকাশ করেন বিদ্রোহী প্রার্থীরা। তারা চিৎকার করে তাদের কথা বলার চেষ্টা করেন। তাদের ক্ষোভের মধ্যেই মঞ্চ ছাড়েন আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা। ভিতরে কথা বলতে না দেওয়ায় বাইরে এসেও বিক্ষোভ করেন বিদ্রোহী কাউন্সিলর প্রার্থীরা।
দৈনিক চট্টগ্রামের এই প্রতিবেদক কথা বলেন দলটির সমর্থনবঞ্চিত একাধিক কাউন্সিলরপ্রার্থীর সঙ্গে। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, এটা স্থানীয় নির্বাচন। এখানে ধমক দিয়ে অপরাধে যুক্ত, অনৈতিক কর্মকা-ে যুক্ত, মাদক-সন্ত্রাসে যুক্ত, কিশোর গ্যাং অপরাধে যুক্তদের কৌশলে জনপ্রতিনিধি করে দেয়ার অপকৌশল নেয়া হয়েছে। যাদের সাথে ওয়ার্ডের তৃণমূল মানুষের ন্যূনতম যোগাযোগ বা সম্পৃক্ততা নেই, তাদেরকে দল সমর্থন দিয়েছে; এটা মেনে নেয়ার মতো নয়। যদি সৎ চরিত্রের একটা সাধারণ ব্যক্তিকেও দল সমর্থন দেয়, তবে আমরা প্রার্থীতা প্রত্যাহার করে তার পক্ষেই কাজ করবো।
কয়েকজন প্রার্থী অভিযোগ করেন, তৃণমূল, ওয়ার্ড, থানা ও মহানগর কমিটির নেতৃবৃন্দের কোনো ধরণের মতামত না নিয়ে নেত্রীর কানে ভুল তথ্য দিয়ে অপরাধী ও প্রশ্নবিদ্ধদের দলীয় সমর্থন আদায়ে টাকা নিয়েছেন অনেকে- এটা আমরা জানি। যেহেতু এলাকায় আমাদের নির্বাচন করার চাপ আছে, দলীয় নেতা-কর্মীরা আমাদের সাথে আছেন, সেহেতু এই নির্বাচন থেকে সরে আসার কোনো সুযোগ নেই।
কোনো কোনো প্রার্থী বলেন, আগামি ৮ মার্চ চট্টগ্রামে আসবেন দলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। আমরা সেই সভায় আমাদের অবস্থান তুলে ধরার চেষ্টা করবো। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নেবো। তবে উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হলে আমরা নির্বাচনী মাঠ থেকে সরবো না। আরাম ৮ মার্চ পর্যন্ত অপেক্ষা করবো।
উল্লেখ্য, আগামি ২৯ মার্চ অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া এবারের চসিক নির্বাচনে কাউন্সিলর পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে আওয়ামী লীগের দলীয় সমর্থন না পাওয়া ১৩ জন সাধারণ ও ৫ জন বর্তমান নারী কাউন্সিলর এবং দলের বিভিন্ন পদে থাকা আরও অন্তত ১০ জন দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে প্রার্থী হয়েছেন। গত ২৭ ফেব্রুয়ারি শেষ দিন পর্যন্ত তারা চসিক নির্বাচনে চট্টগ্রাম আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা ও রিটার্নিং অফিসারের কার্যালয়ে মনোনয়নপত্র জমা দেন। এছাড়াও দলের বিভিন্ন পর্যায়ের একাধিক পদবিহীন নেতা নির্বাচনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন। এ নিয়ে বেশ বেকায় রয়েছে ক্ষমতাসীন দলটি।

ডিসি/এসআইকে/আইএস