মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল: দ্রুতগতিতে চলছে অবকাঠামো নির্মাণের কাজ

আজমল হোসেন, মিরসরাই প্রতিনিধি >>>
উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়নাধীন মিরসরাইয়ে। গত বছরের ২৪ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্র থেকে বেপজা ইন্টারন্যাশনাল ইনভেস্টরস্ সামিট-১৮ অনুষ্ঠানে ৩০ হাজার একরের এই প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর ফলক উন্মোচন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। পরবর্তীতে ২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক)-এ মিরসরাই বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলের প্রথম পর্যায়ের কাজের জন্য ৭৫০ কোটি টাকার উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) অনুমোদিত হয়।
মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলের কাজও চলছে দ্রুতগতিতে। ইতোমধ্যেই বিনিয়োগকারীদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বাস্তবায়নাধীন এই ইকোনোমিক জোনটি। ৩০ হাজার একর জমির উপর এই ইকোনোমিক জোন স্থাপন হচ্ছে। এ অর্থনৈতিক অঞ্চলে ২৫টি আলাদা জোন হবে বলে জানা গেছে। যেটি ছিলো একসময় কেবল ধু ধু চরাঞ্চল সেটি জুড়ে এখন চলছে বিশাল কর্মযজ্ঞ। সাগর থেকে মাটি এনে ভরাট করা হচ্ছে জমি। ইট-বালু আর সিমেন্টের সংমিশ্রণে গড়ে উঠছে বিশাল বিশাল ভবন। যে পথে একসময় চরে বেড়াত গরু-মহিষ, সে গহীন চরের বুকে জেগেছে শিল্পের অট্টালিকা, লেগেছে উন্নয়নের ছোঁয়া। চরাঞ্চলের বুকচিরে নির্মিত হচ্ছে চার লেনের সড়ক।
থেমে নেই সাগরপাড়ের বেড়িবাঁধ নির্মাণ কাজও। পুরো এলাকায় উন্নয়নের বিশাল কর্মযজ্ঞ চলছে। উপযুক্ত জমির অভাবে এতো দিন বিনিয়োগ করতে না পারা অনেক প্রতিষ্ঠান এখানে জমি নিচ্ছে।
বর্তমানে মিরসরাই শিল্পজোনের ফেইজ-২এ ও ২বি এলাকায় প্রথম ধাপের উন্নয়ন কাজ চলছে। আগামি এক থেকে দেড় বছরের মধ্যে এসব জমি শিল্প-কারখানা স্থাপন ও বিনিয়োগ উপযোগী হয়ে উঠবে। প্রকল্প এলাকায় যাতায়াতের জন্য ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে চার লেনবিশিষ্ট সংযোগ সড়ক নির্মাণ, অভ্যন্তরীণ সড়ক নির্মাণ, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও জাহাজ ভেড়াতে টার্মিনাল স্থাপন, প্রশাসনিক ভবন নির্মাণ, সুপেয় পানির সরবরাহে গভীর নলকূপ স্থাপন, পর্যটন সম্ভাবনা তৈরি করতে পাঁচটি কৃত্রিম লেকের সমন্বয়ে ‘শেখ হাসিনা সরোবর’ তৈরি ও সমুদ্র প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ হচ্ছে।
প্রথম পর্যায়ের কাজের অংশ হিসেবে বেপজা ইকোনোমিক জোন প্রকল্পের চারপাশে ডাইক (বাঁধ) নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে রয়েছে। ফলে অল্প দিনের মধ্যে পুরোপুরি বিনিয়োগ উপযোগী হয়ে উঠবে বলে আশা করছে বেপজা কর্তৃপক্ষ। পুরো অর্থনৈতিক অঞ্চল রক্ষার জন্য (সুপার ডাইক) বাঁধের কাজও দ্রুতগতিতে চলছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধানে চায়না হারবার ইঞ্জিনিয়ারিং এই বাঁধের কাজ করছে।
প্রকল্পের ভূমি উন্নয়নের কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। এখানে বিনিয়োগকারীদের জন্য মোট ৬১৮টি শিল্প প্লট তৈরি করা হবে। যেখানে প্রায় ৩০০-৩৫০টি শিল্প প্রতিষ্ঠান স্থাপন সম্ভব হবে। বেপজা অর্থনৈতিক অঞ্চলে প্রায় ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা যাবে যেখানে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে। ধাপে ধাপে বাস্তবায়নাধীন বেপজা’র বৃহত্তর প্রকল্পটির প্রথম পর্যায়ে ২০২১ সালের জুনের মধ্যে ২৫০টি শিল্প প্লট তৈরি করা হবে। সেখানে দেড় লাখ বাংলাদেশি শ্রমিকের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে বলে আশা করছে বেপজা।
এ শিল্পাঞ্চলটি মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল নামে পরিচিতি লাভ করলেও নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেজা এর নাম দিয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর। সীতাকু-, মিরসরাই ও সোনাগাজী উপজেলার মোট ৩০ হাজার একর জমি নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব শিল্পনগর স্থাপন করা হচ্ছে। এ শিল্পাঞ্চল শুধু বাংলাদেশ নয় বরং উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় শিল্পনগরী।
এরই মধ্যে আগ্রহী বিদেশি বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে চারটি চীনা কম্পানিকে বিনিয়োগের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। জাপানের অন্যতম বৃহৎ শিল্প গ্রুপ সুজিতসু কর্পোরেশনকে জমি বরাদ্দের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে। সুজিতসু কর্পোরেশন একটি আলাদা বন্দর স্থাপন করবে। ‘ইন্ডিয়ান ইকোনোমিক জোন’ করতে ১ হাজার ৫৪ একর জমি ও একটি আইটি পার্ক করতে ৭২০ কোটি টাকা ভারত বিনিয়োগ করবে। সিঙ্গাপুর, সৌদি আরব, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়ার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানও এখানে বিনিয়োগ করবে। সর্বশেষ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের বাণিজ্য যুদ্ধের কবলে পড়ে চীনের ঝুঝাউ জিনইউয়ান কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি মিরসরাই ইপিজেডে ১০ একর জমি নিয়েছে বিনিয়োগের জন্য।
এ ছাড়া বাংলাদেশের পিএইচপি, বসুন্ধরা গ্রুপ, বিএসআরএম স্টিল, এসিআই, যমুনা গ্রুপের মতো শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়িক গ্রুপগুলোও মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্প-কারখানা স্থাপনের জন্য জমি নিয়েছে। বিজিএমইএ গার্মেন্টপল্লী স্থাপনের জন্য ৫০০ একর জমি বরাদ্দ নিয়েছে এই অর্থনৈতিক অঞ্চলে।
মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলকে বিনিয়োগের ভবিষ্যৎ রাজধানী উল্লেখ করে বেজার নির্বাহী চেয়ারম্যান পবন চৌধুরী বলেন, ‘মিরসরাইয়ে এখন পর্যন্ত ১২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। এটা ২৫ বিলিয়নে উন্নীত হবে বলে আশা করছি। পুরোদমে চালু হলে ৫ লাখ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে এখানে’।
জমি বরাদ্দের জন্য ২০১৭ সালের এপ্রিল মাসে আবেদন নেওয়া শুরু করে বেজা। এরই মধ্যে সেখানে বিপুল বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে। বেজা এরই মধ্যে সেখানে কারখানা করার জন্য চার হাজার একরের মতো জমি বরাদ্দ দিয়েছে। মোট প্রস্তাব অনুমোদন দেওয়া হয়েছে ৫৬টি। এর মধ্যে জমি পেয়েছে ৩৯টি। এসব কম্পানি প্রায় ১২ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছে।

ডিসি/এসআইকে/এসএএইচ