শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শে ইউজিসির মিথ্যা প্রতিবেদন : কলিমউল্লাহ

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির পরামর্শে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি) মিথ্যা প্রতিবেদন দিয়েছে বলে অভিযোগ করেছেন রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের (বেরোবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ।
বৃহস্পতিবার (৪ মার্চ) ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির (ডিআরইউ) সাগর-রুনি মিলনায়তনে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনের শুরুতে সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে এ অভিযোগ করেন তিনি।  কলিমুল্লাহ বলেন, শিক্ষামন্ত্রীর পরামর্শে ইউজিসির কমিটি হয়েছে, তার পরামর্শে প্রতিবেদন দেয়া হয়েছে।  তার অফিস থেকে তদন্ত প্রতিবেদনের খণ্ডিত অংশ লিক করা হয়েছে।  একটা তকমা আমাদের ঘাড়ে দিয়ে দেয়ার জন্য এসব করা হচ্ছে।  এখানে খুবই ন্যাক্কারজনক এক রাজনীতির খেলা হয়েছে।  সর্বোচ্চ শিক্ষাঙ্গন এ ধরনের হীন রাজনীতি করার জায়গা না।  এটি আমি নির্ভয়ে বলতে চাই।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির বিরুদ্ধে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত বসিয়ে রাখার অভিযোগ তুলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেছেন, তিনি (ডা. দীপু মনি) শিক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব নেয়ার পর সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যরা দেখা করতে যাই।  সকাল ১০ টার প্রোগ্রাম তিনি এসেছিলেন বিকেল ৪ টায়।  আমাদের সব উপচার্যদের পুরোটা দিন তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে।  সেটা খুবই অসৌজন্যমূলক কাজ হয়েছে।  বাংলাদেশের ইতিহাসে কখনই এমনটি ঘটেনি।
তিনি বলেন, যতবার আমরা রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শিক্ষামন্ত্রীর কাছে ক্রোড়পত্রের বাণী চেয়েছি, পাইনি। রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বাণী নিয়ে কখনও কার্পণ্য করেননি, কিন্তু শিক্ষামন্ত্রীর বাণী কখনও পাইনি।  আমি খোলামেলা কথা বলার মানুষ।  আজ কিছু অপ্রিয় সত্য কথা বলতে এখানে এসেছি এবং পরিণতি বিবেচনা করেই এসেছি।
কলিমুল্লাহ বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের দায়িত্ব নেয়ার পর থেকেই যা অপপ্রচার, অপবাদ হয়েছে সব শিক্ষামন্ত্রীর আনুকূল্যে হয়েছে।  আজকে লুকিয়ে চাপিয়ে কথা বলব না।  সব খোলসা করতে এসেছি।  আমি দীর্ঘদিন ধরে মিডিয়া ও নির্বাচন নিয়ে কাজ করি।  সেজন্য আমি পরিষ্কার করে কথা বলতে পছন্দ করি।  আমি কোনোদিন সত্য কথা বলতে পিছপা হইনি, আজও হব না।
ভিসি জানান, পুরো বিষয়টি আমি প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত করেছি।  এ পর্যন্ত আমি যা কিছু করেছি সবকিছুই প্রধানমন্ত্রীর শ্রুতি নির্দেশে করেছি বলেও উল্লেখ করেন ভিসি।  তিনি বলেন, আমাদের দেশে দুর্নীতি ধামাচাপ দেয়ার একটি প্রবণতা আছে।  আমি কেন অভিযোগ করলাম এটাই বোধ হয় আমি অপরাধ করেছি।  বিষয়টি অন্যদিকে ধামাচাপা ও অন্যদিকে মোড় নেয়ার জন্য আজকের এসব ঘটনা ঘটানো হয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উপস্থিত না থাকার বিষয়ে অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ বলেন, সংসদে পাস হওয়া আইনে বলা নেই উপাচার্যকে ক্যাম্পাসে থাকতে হবে।  রেজিস্ট্রারকে ক্যাম্পাসে থাকতে হবে বলে বলা হয়েছে।  এসময় রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে জারি করা উপাচার্য নিয়োগে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপন আইনের সাথে সাংঘর্ষিক বলেও মন্তব্য করেন তিনি।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটসহ অন্যান্য সভা ঢাকার অফিসে করার বিষয়ে উপাচার্য বলেন, রংপুরে সভা করলে অনেক তদবির থাকে।  যা স্বাভাবিক কার্যক্রম পরিচালনা করার মত না।  সেখানকার ঐতিহ্য হইচই করে সিন্ডিকেটে একটা দাবি পেশ করে তা মানতে চাপ দেন।

এর আগে অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহসহ বেরোবির কয়েকজন কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগের প্রমাণ পাওয়ায় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে সুপারিশ করে ইউজিসি।
এদিন লিখিত বক্তব্যে উপাচার্য বলেন, সম্প্রতি বিভিন্ন গণমাধ্যমে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনকে (ইউজিসি) উদ্ধৃত করে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের বিশেষ উন্নয়ন প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে প্রকাশিত সংবাদগুলো আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে।
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুরের চতুর্থ উপাচার্য হিসেবে আমার দায়িত্ব গ্রহণের পর নানামুখী চ্যালেঞ্জ ও প্রতিকূলতাকে মোকাবিলা করে বিশ্ববিদ্যালয়টি যখন গুণগত ও অবকাঠামোগত উন্নয়নের মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে, ঠিক সেই মুহূর্তে সত্যকে আড়াল করে এ ধরনের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর সংবাদ বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকে মর্মাহত করেছে।  যদিও ইউজিসির তদন্ত প্রতিবেদন আনুষ্ঠানিকভাবে আমরা পাইনি।  আমরা লক্ষ্য করছি, চূড়ান্ত তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার আগেই এ বিষয়ে অসত্য ও বিভ্রান্তিকর তথ্য জনমনে নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে।
এ সময় নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ উপস্থিত সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন।  সংবাদ সম্মেলনে বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার আবু হেনা মোস্তফা কামাল, কয়েকজন প্রকৌশলী এবং শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ উপস্থিত ছিলেন।
জানা গেছে, বেরোবির জন্য ২০১৫ সালের ১৩ জানুয়ারি একনেক সভায় ৯৭ দশমিক ৫০ কোটি টাকা অনুমোদন দেয়া হয়।  এর মধ্যে ছাত্রীদের আবাসনের জন্য প্রধানমন্ত্রীর নামে ‘শেখ হাসিনা হল’ এবং প্রধানমন্ত্রীর স্বামীর নামে প্রতিষ্ঠিত ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের জন্য ভবন নির্মাণে ৭৮ কোটি ২২ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়।  প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করা হয় ২০১৫ সালের ১ জানুয়ারি থেকে ২০১৮ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত।
দরপত্রের মাধ্যমে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হিসেবে আর্কিটেক্ট মনোওয়ার হাবিব ও প্রাকৃত নির্মাণ লিমিটেডকে যৌথভাবে কার্যাদেশ দেয়া হয়।  এই টেন্ডারে প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েট লিমিটেড নামে আরেক কোম্পানিও অংশ নিয়েছিল।  তবে সর্বনিম্ন দরদাতা না হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি কাজ পায়নি।
২০১৭ সালের ৪ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রকল্পের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন।  এ সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ছিলেন অধ্যাপক একেএম নূর-উন-নবী।
অভিযোগ রয়েছে, ২০১৭ সালের ১৪ জুন ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর প্রকল্পের নির্মাণকাজ বন্ধ করে দেন।  বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়নকাজ তদারকির জন্য উপাচার্যের ঘনিষ্ঠ প্রকৌশলী মঞ্জুর কাদেরকে পরিকল্পনা, উন্নয়ন ও ওয়ার্কস কমিটির সদস্য নিয়োগ দেয়া হয়।  প্রকৌশলী মঞ্জুর কাদের উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী পরামর্শক প্রতিষ্ঠান প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েটের স্বত্বাধিকারী।
কিছুদিন পর আইন ও চুক্তি লঙ্ঘন করে পরামর্শক প্রতিষ্ঠান আর্কিটেক্ট মনোওয়ার হাবিব ও প্রাকৃত নির্মাণ লিমিটেডের কার্যাদেশ বাতিল করে প্রকৌশলী মঞ্জুর কাদেরকে দ্বিতীয় পরামর্শক নিয়োগ দেয়া হয়।  এক্ষেত্রে আর্কিটেক মনোওয়ার হাবিবকে নানাভাবে ভয়ভীতিও দেখানো হয় বলে অভিযোগ করা হয়।
এরই মধ্যে শেখ হাসিনা ছাত্রী হলের মূল নকশা পরিবর্তন করে একটি অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদ ভবন নির্মাণের চেষ্টা করা হচ্ছে বলে অভিযোগ ওঠে।
ড. ওয়াজেদ রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং ইনস্টিটিউট ভবনের নির্মাণ ব্যয় ২৬ কোটি ৮৭ লাখ থেকে বাড়িয়ে ধরা হয় ৬১ কোটি টাকা।  ৫১ কোটি ৩৫ লাখ টাকা থেকে বাড়িয়ে শেখ হাসিনা ছাত্রী হলের নির্মাণ ব্যয় ধরা হয় ১০৭ কোটি।  অন্যদিকে মূল ডিপিপিতে পরামর্শক ফি না থাকলেও বর্তমানে উপাচার্য সেই খাতে ৪০ লাখ টাকা ব্যয় করেছেন বলে অভিযোগ করা হয়।
এরপর ২০১৯ সালের ১২ ডিসেম্বর শিক্ষামন্ত্রীর সভাপতিত্বে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালকদের নিয়ে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন প্রকল্পের নানা অসঙ্গতি নজরে এলে ইউজিসিকে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়।
মঞ্জুরি কমিশন ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ইউজিসির সদস্য ড. মুহাম্মদ আলমগীরকে আহ্বায়ক করে তিন সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করে।  কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বিভাগের পরিচালক ড. ফেরদৌস জামান এবং অতিরিক্ত পরিচালক ড. দূর্গা রানী সরকার।
চলতি বছরের ১৭ জানুয়ারি সরেজমিনে পরিদর্শন করে ২৫ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন জমা দেয় কমিটি।  প্রতিবেদনে বলা হয়, পরামর্শক প্রতিষ্ঠান মনোওয়ার হাবিব ও প্রাকৃত নির্মাণ লিমিটেডের সঙ্গে সমঝোতা না করে প্রফেশনাল অ্যাসোসিয়েটকে পরামর্শক নিয়োগ দেয়া চুক্তির নিয়মাবলির সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।  পাশাপাশি প্রথম পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের নকশা ও ডিজাইনের ওপর ভিত্তি করে শেখ হাসিনা ছাত্রী হল এবং ড. ওয়াজেদ রিসার্চ ইনস্টিটিউটের ভবন নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী।  ইতোমধ্যে ভবনটির অর্ধেকের বেশি কাজ সম্পন্ন হয়েছে।  এখানে দ্বিতীয় নকশা ও ডিজাইনের প্রয়োজন আছে বলে তদন্ত কমিটি মনে করে না।  এ ধরনের অনৈতিক কাজের জন্য সংশ্লিষ্টদের শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নেয়া যেতে পারে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক ড. মুহাম্মদ আলমগীর বলেন, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে তদন্তকাজ শেষ হয়েছে।  সরেজমিনে বিশ্ববিদ্যালয় পরিদর্শন ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র যাচাই-বাছাই শেষে আমরা উপাচার্যসহ বিশ্ববিদ্যালয়টির কয়েকজনের বিরুদ্ধে ওঠা বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগের প্রমাণ পেয়েছি, যা তদন্ত প্রতিবেদনে তুলে এনেছি।  প্রতিবেদন গত ২৪ ফেব্রুয়ারি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে জমা দিয়েছি।
তিনি আরও জানান, বেরোবির উপাচার্য ক্যাম্পাসে অনুপস্থিতিসহ বেশ কয়েকটি অভিযোগের ব্যাপারে ইউজিসির আরেকটি তদন্ত কমিটি কাজ করছে।  দ্রুত সেসব তদন্ত কাজ শেষ করে প্রতিবেদন জমা দেয়া হবে।
২০১৭ সালের ১ জুন অধ্যাপক ড. নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহকে বেরোবির উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দেয় সরকার।  অধ্যাপক কলিমুল্লাহ জাতীয় নির্বাচন পর্যবেক্ষক পরিষদের (জানিপপ) প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। তিনি বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটি অব প্রফেশনালসের (বিইউপি) উপ-উপাচার্য ছিলেন।  এছাড়া তিনি ঢাবির লোকপ্রশাসন বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ