কিংবদন্তি এটিএম শামসুজ্জামানের সংক্ষিপ্ত জীবনী

বিনোদন ডেস্ক, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
দীর্ঘ রোগভোগের পর শনিবার (২০ ফেব্রুয়ারি) সকালে না ফেরার দেশে পাড়ি জমান একুশে পদকপ্রাপ্ত বর্ষীয়ান অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান।  যিনি শুধু অভিনেতাই নন, দেশের নাটক-সিনেমার চিত্রনাট্য ও নির্মাণ ইতিহাসের সিংহভাগ এলাকাজুড়ে শাসন করেছেন দীর্ঘ সময় নিয়ে- আপন দক্ষতায়।
তারচেয়ে দীর্ঘ ও গভীর অভিনয় জীবন এই দেশের আর কোনো অভিনেতা পেয়েছেন বলে জানা নেই।  যিনি অভিনয়ের প্রায় প্রতিটি শাখায় বিচরণ করেছেন অসম্ভব সফলতার সঙ্গে।  একাধারে তিনি অভিনেতা, পরিচালক, কাহিনিকার, চিত্রনাট্যকার, সংলাপ রচয়িতা ও গল্পকার হিসেবে কাজ করেছেন।  বড় বিষয়, এই অভিনেতা ছিলেন ইন্ডাস্ট্রির সর্বজন শ্রদ্ধেয়।  আর দর্শক ভালোবাসার কথাতো উল্লেখ করারই প্রয়োজন নেই।
এটিএম শামসুজ্জামানের শুরুটা হয় মঞ্চ থেকে।  চলচ্চিত্রজীবন শুরু করেন কৌতুক অভিনেতা হিসেবে।   তারপর খল অভিনেতা হিসেবেও পান তুমুল করতালি।
১৯৪১ সালের ১০ সেপ্টেম্বর নোয়াখালীর দৌলতপুরে নানাবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন এটিএম শামসুজ্জামান।  গ্রামের বাড়ি লক্ষ্মীপুর জেলার ভোলাকোটের বড় বাড়ি আর ঢাকায় থাকতেন সূত্রাপুর দেবেন্দ্রনাথ দাস লেনে পৈত্রিক বাড়িতে।  পড়াশোনা করেছেন ঢাকার পগোজ স্কুল, ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট স্কুল ও রাজশাহীর লোকনাথ হাই স্কুলে।  পগোজ স্কুলে তার বন্ধু ছিলেন আরেক অভিনেতা প্রবীর মিত্র।  ম্যাট্রিকুলেশন পাশ করেন ময়মনসিংহ সিটি কলেজিয়েট হাই স্কুল থেকে।  তারপর জগন্নাথ কলেজে ভর্তি হন।
অভিনেতার বাবা নূরুজ্জামান ছিলেন নামকরা উকিল এবং শেরে বাংলা একে ফজলুল হকের সঙ্গে রাজনীতি করতেন।  মাতা নুরুন্নেসা বেগম।  পাঁচ ভাই ও তিন বোনের মধ্যে শামসুজ্জামান ছিলেন সবার বড়।
এই অভিনেতা প্রথম কাহিনি ও চিত্রনাট্য লিখেছেন ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রের জন্য।  ছবির পরিচালক ছিলেন নারায়ণ ঘোষ মিতা, এ ছবির মাধ্যমেই অভিনেতা ফারুকের চলচ্চিত্রে অভিষেক।  এ পর্যন্ত শতাধিক চিত্রনাট্য ও কাহিনি লিখেছেন এই অভিনেতা।
অভিনেতা হিসেবে চলচ্চিত্র পর্দায় আগমন ১৯৬৫ সালের দিকে।  তবে আলোচনায় আসেন ১৯৭৬ সালে আমজাদ হোসেনের ‘নয়নমণি’ চলচ্চিত্রে খলনায়কের চরিত্রের মাধ্যমে।  ১৯৮৭ সালে কাজী হায়াত পরিচালিত ‘দায়ী কে’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করে শ্রেষ্ঠ অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।  রেদওয়ান রনি পরিচালিত ‘চোরাবালি’তে অভিনয় করেন ও শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব-চরিত্রে অভিনেতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।
শিল্পকলায় অবদানের জন্য ২০১৫ সালে পেয়েছেন একুশে পদক।  ১৯৬১ সালে পরিচালক উদয়ন চৌধুরীর ‘বিষকন্যা’ চলচ্চিত্রে সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেন।  এরপর খান আতাউর রহমান, কাজী জহির, সুভাষ দত্তের সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন।  তবে ২০০৯ সালে প্রথম পরিচালনা করেন শাবনূর-রিয়াজ জুটিকে নিয়ে ‘এবাদত’ নামের ছবি।
অভিনয়-নির্মাণের পাশাপাশি একজন লেখক হিসেবেও এটিএম শামসুজ্জামান সফল।  কাহিনিকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি।  এই অভিনেতা নাটক-সিনেমার পাণ্ডুলিপির বাইরে গল্প-কবিতাও লেখার চর্চা করেছেন নানাভাবে। 
অভিনয়জীবনের শুরুতে ষাটের দশকে টিভি নাটকে অংশগ্রহণ ছিল তার।  যা অব্যাহত ছিলো জীবনের শেষপ্রান্ত পর্যন্ত।  তার উল্লেখযোগ্য টিভি ধারাবাহিকের মধ্যে রয়েছে হলো- ‘রঙের মানুষ’, ‘ভবের হাট’, ‘ঘর কুটুম’, ‘বউ চুরি’, ‘নোয়াশাল’ প্রভৃতি।
অভিনীত উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে ‘বড় বউ’, ‘অবুঝ মন’, ‘ওরা ১১ জন’, ‘শ্লোগান’, ‘স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা’, ‘সংগ্রাম’, ‘ভুল যখন ভাঙলো’, ‘চোখের জলে’, ‘লাঠিয়াল’, ‘অভাগী’, ‘নয়নমনি’, ‘যাদুর বাঁশি’, ‘গোলাপী এখন ট্রেনে’, ‘অশিক্ষিত’, ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘লাল কাজল’, ‘পুরস্কার’, ‘প্রিন্সেস টিনা খান’, ‘রামের সুমতি’, ‘ঢাকা ৮৬’, ‘দায়ী কে?’, ‘রাজলক্ষ্মী শ্রীকান্ত’, ‘দোলনা’, ‘পদ্মা মেঘনা যমুনা’, ‘অজান্তে’, ‘স্বপ্নের নায়ক’, ‘তোমার জন্য পাগল’, ‘ম্যাডাম ফুলি’, ‘চুড়িওয়ালা’, ‘শ্বশুরবাড়ী জিন্দাবাদ’, ‘জামাই শ্বশুর’, ‘আধিয়ার’, ‘শাস্তি’, ‘মোল্লা বাড়ির বউ’, ‘হাজার বছর ধরে’, ‘আমার স্বপ্ন তুমি’, ‘দাদীমা’, ‘আয়না’, ‘ডাক্তার বাড়ী’, ‘চাঁদের মতো বউ’, ‘মন বসেনা পড়ার টেবিলে’, ‘এবাদাত’সহ অসংখ্য ছবি।
পারিবারিক জীবনে খানিক ব্যর্থতার ছাপ এনে দিয়েছে তার দুই পুত্র সন্তান।  ২০১২ সালে তার বড় সন্তান এটিএম কামালুজ্জামান কবিরকে নিজ বাসায় হত্যা করে ছোট ছেলে এটিএম খলিকুজ্জামান কুশল।  এরপর পিতা হয়েও ছোট ছেলের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা করেন এই অভিনেতা।  সাক্ষ্য দেন আদালতে গিয়ে।  ভাইকে হত্যার দায়ে যাবজ্জীবন জেল হয় কুশলের।  তবে অভিনেতার অন্য এক ছেলে এবং ৩ মেয়ে মৃত্যু পর্যন্ত বাবাকে আগলে রেখেছিলেন পরম মমতায়।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ