চরম সংকটে কক্সবাজারের পর্যটন শিল্প

কক্সবাজার প্রতিনিধি, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
পর্যটন ব্যবসা না থাকায় চরম সংকটে ভুগছে দেশের বৃহত্তম পর্যটন শিল্পনগরী কক্সবাজার।  চলমান করোনা মহামারির কারণে কক্সবাজার পর্যটন শিল্পে দেখা দিয়েছে চরম সঙ্কট।  দ্বিতীয় দফায় সংক্রমণরোধ ও সর্বাত্মক লকডাউনে জনশূন্য জনপদে পরিণত হয়েছে কক্সবাজার।  আর লকডাউনের প্রভাবে কক্সবাজারের পর্যটন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায় অন্তত আড়াই হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, পর্যটন জোন ও শহরের পাঁচ শতাধিক হোটেল–মোটেল–রেস্তোরাঁ সব পর্যটক শূন্য।  ফলে ব্যবসা-বাণিজ্যে নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস অ্যান্ড রিসোর্টের পরিচালক আবদুল কাদের মিশু বলেন, পর্যটক নেই অথচ হোটেল খোলা রাখতে হচ্ছে।  ফলে ২৫০ রুমের হোটেলটির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন, বিদ্যুৎ খরচ, ব্যাংকের কিস্তিসহ নানা খাতে দৈনিক লোকসান যাচ্ছে প্রায় চার লাখ টাকা।
তারকা হোটেল দি কক্স টু ডে’র ব্যবস্থাপক আবু তালেব বলেন, দ্বিতীয় দফায় লকডাউনের শুরু থেকেই খালি পড়ে আছে হোটেল।  ফলে কর্মচারীর বেতন, বিদ্যুৎ খরচসহ নানা খাতে দৈনিক লোকসান হচ্ছে তিন লাখ টাকা।
শুধু এ দুই হোটেলই নয়, অন্য তারকা হোটেল, গেস্ট হাউজ, মোটেল, কটেজ ও ফ্ল্যাটসহ পর্যটনসেবী প্রায় সাড়ে চারশ আবাসন প্রতিষ্ঠানে পর্যটক না থাকায় খাঁ খাঁ করছে।
হোটেল-মোটেল অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশন সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, শহরের হলিডে মোড় হতে কলাতলীর দরিয়ানগর সৈকত এলাকা পর্যন্ত তিন বর্গকিলোমিটার এলাকায় হোটেল-মোটেল, গেস্টহাউস ও কটেজ রয়েছে চার শতাধিক।  এপ্রিলের শুরু থেকে কোনো হোটেলে অতিথি নেই।  লকডাউনের বিষয়ে জানতে পেরে অধিকাংশ হোটেল-মোটেল ও গেস্টহাউস কর্তৃপক্ষ ১ এপ্রিলের আগেই ৯৩ শতাংশ কর্মচারীকে বাধ্যতামূলক ছুটিতে পাঠিয়েছে।  বর্তমানে পাঁচ থেকে সাত শতাংশ কর্মচারী হোটেল–মোটেলে অবস্থান করে সম্পদ পাহারা দিচ্ছেন।
ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন কক্সবাজারের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার বলেন, গত ৫২ দিনে নগরীর প্রায় সাড়ে ৪০০ আবাসন প্রতিষ্ঠানে দিনে ক্ষতি প্রায় ১০ কোটি টাকা।  আর আড়াই শতাধিক খাবার হোটেলে ক্ষতি হচ্ছে প্রায় তিন কোটি টাকা করে।  হোটেল রিলেটেড আনুষঙ্গিক অন্যান্য সেক্টরে ক্ষতি প্রায় সাত কোটি টাকা।
হোটেল-মোটেল অফিসার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাংগঠনিক সম্পাদক ও হোয়াইট অর্কিড হোটেলের মহাব্যবস্থাপক রিয়াদ ইফতেখার বলেন, লকডাউনে শহরের মার্কেট, দোকানপাট সবই খোলা রেখে শুধু পর্যটন বন্ধ রাখা হাস্যকর।  স্বাস্থ্যবিধি মেনে সৈকতে সীমিত পরিসরে হলেও ভ্রমণের সুযোগ দেয়া না হলে পর্যটন খাতে চরম ধস নামবে।
কক্সবাজার কলাতলী মেরিন ড্রাইভ হোটেল রিসোর্ট মালিক সমিতির সম্পাদক মুকিম খান বলেন, এখানে হোটেল–মোটেল ও রিসোর্ট রয়েছে ৫২টি।  করোনাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিচ্ছি।  এরপরও কর্মচারীদের মানবিক দিক বিবেচনায় নিতে হবে।  কেননা বন্ধের কারণে ৫২ হোটেল ও রিসোর্টের অন্তত পাঁচ হাজার কর্মচারী বেকার জীবন কাটাচ্ছেন।  অধিকাংশ কর্মচারীর বেতন–ভাতাও পরিশোধ হয়নি।  তাই সীমিত পরিসরে হলেও সৈকত খুলে দেয়া উচিত।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল গেস্টহাউস মালিক সমিতির সভাপতি ওমর সুলতান বলেন, সমিতির আওতাভুক্ত শতাধিক হোটেল ও গেস্টহাউস প্রায় দুই মাস ধরে বন্ধ।  ব্যাংক ঋণ নিয়ে পরিচালিত হচ্ছে অধিকাংশ হোটেল।  ব্যবসায় ধস সামলাতে হলে পর্যটন সচল করার বিকল্প নেই।
ট্যুরস ওনার অ্যাসোসিয়েশন অব কক্সবাজারের (টুয়াক) সভাপতি রেজাউল করিম বলেন, কক্সবাজারে প্রতি বছর দেশি-বিদেশি মিলিয়ে অর্ধকোটি পর্যটক আসেন।  তাদের যাতায়াতে প্রতিদিন দূরপাল্লার অনেক বাস ও ১০-১২টি ফ্লাইট যাতায়াত করে।  পর্যটক সেবায় থাকা হোটেল-মোটেল, কটেজ, রেস্টুরেন্ট ও বিমান চলাচল সবই বন্ধ রয়েছে গত প্রায় দুই মাস ধরে।  এতে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার ব্যবসা ভেস্তে গেছে।
হোটেলের মালিকরা বলেন, করোনার প্রভাবে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে টানা পাঁচ মাস হোটেল ও রেস্তোরাঁ বন্ধ ছিল।  ১৭ আগস্টের পর সেগুলো খোলার প্রস্তুতি নিতেই চলে যায় আরও মাস দুয়েক।  নভেম্বর-ডিসেম্বর, জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে কিছুটা ব্যবসা হয়েছে।  কিন্তু মার্চে করোনার প্রাদুর্ভাবে আবারও ভাটা পড়ে পর্যটনে।  আর এপ্রিলের শুরুতেই লকডাউন সবকিছু স্তব্ধ করে দিয়েছে।
কক্সবাজার হোটেল-মোটেল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সিনিয়র সহ-সভাপতি লায়ন এম এন করিম বলেন, পর্যটন শিল্পে অশনিসংকেত এনেছে করোনা।  ব্যাংক ঋণের চক্রবৃদ্ধি সুদ দিন দিন বোঝা বাড়াচ্ছে।  বাড়ছে প্রতিষ্ঠান টিকিয়ে রাখার শঙ্কাও।  এভাবে চলতে থাকলে দেউলিয়া হতে হবে।  পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে পর্যটন ব্যবসায়ীদের প্রণোদনা ও সহজ শর্তে ঋণেই কেবল পারে পর্যটন শিল্প বাঁচিয়ে রাখতে।
কক্সবাজার চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি আবু মোরশেদ চৌধুরী খোকা বলেন, গত বছরের মতো এবারও গত দুই মাস কক্সবাজারে সব ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ থাকায় পর্যটনের অর্থনীতি নিম্নমুখী।  আমাদের হিসাবে প্রতিদিন ৪৫-৫০ কোটি টাকার ব্যবসায়িক ক্ষতি হচ্ছে।  এভাবে আরও কিছুদিন চলতে থাকলে ধস আরও নামবে।  ইতোমধ্যে এখানকার ব্যবসা-বাণিজ্যে আড়াই হাজার কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে।  স্বাস্থ্যবিধি মেনে পর্যটন খাতসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ খুলে দেয়া হলে ক্ষতি কিছুটা এড়ানো সম্ভব।
কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. মামুনুর রশীদ বলেন, পর্যটন সম্ভাবনাময় শিল্প।  এ খাতে সরকারের বিশেষ নজর রয়েছে।  চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট দফতরে লিখিতভাবে জানানো হয়েছে।  পর্যটনসেবীদের জন্য কোনো বরাদ্দ এলে তা যথাযথভাবে বিতরণ করা হবে।

ডিসি/এসআইকে/এফআরইউ