মস্কো নিরাপত্তা সম্মেলনে যে বার্তা দিল বাংলাদেশ

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
‘পশ্চিমা বিশ্বের উন্নয়নের ধারণার বিকল্প অনুসন্ধান ও নতুন ধরনের সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করে বহুপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার’ সেøাগান নিয়ে ১৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত হলো একাদশ মস্কো আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্মেলন। এই সম্মেলনে অংশ নিয়ে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার সমালোচনা করে তৃতীয় দেশগুলোর ক্ষতির কথা তুলে ধরেছে বাংলাদেশ। বৈশ্বিক রাজনীতির মেরুকরণ যখন অনেকটাই জটিল আকার ধারণ করেছে, তখন নির্বাচন সামনে রেখে পশ্চিমা তৎপরতার মধ্যে বাংলাদেশের এই বার্তা গুরুত্বপূর্ণ।
এই সম্মেলন নানা কারণেই গুরুত্বপূর্ণ। ২০২২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি রাশিয়া ইউক্রেনে আক্রমণের পর থেকেই পশ্চিমা বিশ্ব রাশিয়াকে ‘একঘরে’ করার চেষ্টা করেছে। এই লক্ষ্যে তারা রাশিয়ার ওপর নানাবিধ নিষেধাজ্ঞা ও অবরোধ আরোপ করেছে। তবে এর ঠিক আগে চীনে অনুষ্ঠিত ২০২২ সালের শীতকালীন অলিম্পিকের সময় চীনা প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বেইজিং-মস্কোর সম্পর্ককে ‘সীমাহীন’ বলে ঘোষণা দেন। এরপর থেকেই দুটি দেশের মধ্যে সম্পর্ক আরও গভীর হয়েছে। বিপরীতে তাইওয়ান ইস্যু এবং সেমিকন্ডাক্টর শিল্প নিয়ে চীনের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কে তিক্ততা এসেছে।
এই প্রেক্ষাপটে সংগত কারণেই রাশিয়া ও চীন বহু বছর ধরেই বিশ্বব্যবস্থার নতুন মেরুকরণের কথা বলছে। গত বছরের সেপ্টেম্বরে উজবেকিস্তানের প্রাচীন শহর সমরখন্দে সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) সম্মেলনে পুতিন সিকে বলেন, ‘পশ্চিমারা বিশ্বে এককেন্দ্রিক ব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে চেষ্টা করছে। এটা অত্যন্ত আপত্তিকর। যেকোনো দেশের বিকাশের পথে এটা বাধা’।
পুতিন আরও বলেন, ‘বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানকে পশ্চিমাদের নিজেদের সুরক্ষার জন্য ব্যবহার, অবৈধ নিষেধাজ্ঞা ও অর্থনৈতিক স্বার্থপরতা অত্যন্ত ভয়াবহ। তবে সুখবর হলো, পশ্চিমাদের বাইরে ক্ষমতার নতুন নতুন কেন্দ্রে গড়ে উঠছে। নতুন কেন্দ্রগুলো নিজেদের মধ্যে সহযোগিতা বাড়াচ্ছে’।
রুশ প্রেসিডেন্টের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট যে, তাঁরা পশ্চিমাদের আরোপিত বিশ্বব্যবস্থা নিয়ে বিরক্ত। তাদের চাওয়া নতুন একটি ব্যবস্থা। পশ্চিমারাও চীন ও রাশিয়াকে তাদের নিরাপত্তা ও স্বার্থের জন্য হুমকি হিসেবেই বিবেচনা করছে। গত বছরের জুলাইয়ে প্রকাশিত পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর সর্বশেষ কৌশলগত ধারণাপত্রে জোটটি শত্রু-প্রতিপক্ষ নির্ধারণের ক্ষেত্রে বেশ স্পষ্টবাদিতার পরিচয় দিয়েছে। জোটটি চীনকে ‘চ্যালেঞ্জ’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে এবং রাশিয়াকে ‘উল্লেখযোগ্য ও সরাসরি হুমকি’ হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। চীনকে এভাবে চিহ্নিত করার পেছনে ইউক্রেন যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে মস্কো-বেইজিং ক্রমবর্ধমান ঘনিষ্ঠতাকেই কারণ হিসেবে দেখছেন বিশ্লেষকেরা। তাঁরা বলছেন, চীনকে এভাবে চিহ্নিত করার ফলে বিশ্বে অস্থির অবস্থা তৈরি হতে পারে।
পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে গত প্রায় দেড় দশকের মধ্যে চীন-রাশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে নতুন মাত্রা যোগ হয়েছে। বাংলাদেশ উন্নয়ন ফোরাম নামে পশ্চিমাদের অনুদানের ওপর নির্ভরতা কমেছে। আওয়ামী লীগের চলমান সরকার বিভিন্ন খাতে চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক বেশ জোরদার করেছে। পরাশক্তিগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা ছিল খুবই দৃশ্যমান। রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র বাংলাদেশে রাশিয়ার সবচেয়ে বড় বিনিয়োগ। এ ছাড়া বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনীতেও রাশিয়ার যুদ্ধবিমান ও বিভিন্ন যুদ্ধাস্ত্র ব্যবহার হয়ে থাকে।
এর বাইরে বেসামরিক খাতে বাংলাদেশের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যের পরিমাণও খুব বড় আকারের না হলেও একেবারে নগণ্য নয়। ২০২১-২২ অর্থবছরে রাশিয়া থেকে ৬৩ কোটি ৯০ লাখ ডলার আমদানি করেছে বাংলাদেশ। বিপরীতে দেশটিতে রপ্তানি করেছে ৫৯ কোটি ৪০ লাখ ডলারের বেশি। দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যিক সম্পর্ক আরো গভীর করার আলোচনাও চলছে। এমনকি রাশিয়া থেকে এলএনজি এবং অপরিশোধিত জ্বালানি কেনার কথাও শোনা গিয়েছিল একবার।
বাংলাদেশ ১৪ বছরের বেশি সময় ধরে যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, চীন ও ভারতের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখেছে। কিন্তু রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরুর পর পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। এই যুদ্ধের কারণে রাশিয়া পশ্চিমা নানা নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়েছে। দেশটির বিরুদ্ধে জাতিসংঘে একাধিকবার প্রস্তাব উঠলেও বাংলাদেশ ভোট দেওয়া থেকে বিরত রয়েছে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের আপত্তির মুখে বিদ্যুৎকেন্দ্রের মালবাহী রুশ জাহাজ বন্দরে ভিড়তে না দেওয়ায় কিছুটা নাখোশ ছিল মস্কো। তার অর্থ এই নয় যে, যুক্তরাষ্ট্রকে খুশি করতে অতি আগ্রহী বাংলাদেশ। বরং, বাণিজ্যিক কারণে কিছুটা চাপের মুখেই রাশিয়াকে বেজার করতে হয়েছে।
এমন প্রেক্ষাপটে ‘মস্কো কনফারেন্স অন ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্সে’ যোগ দেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে যখন বাংলাদেশের আসন্ন জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের পদচারণা শুরু হয়েছে। পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে এখানে চীন ও রাশিয়ার অবস্থান অনেকটাই দ্বান্দ্বিক। যেখানে পশ্চিমা বিশ্ব বাংলাদেশে সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিষয়ে উদ্যোগী হয়েছে এবং বিশেষত যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা সতর্কতামূলক ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে।
তবে চীন ও রাশিয়া এমন পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি আরোপের পরপরই গত ২২ জুন চীনের রাষ্ট্রদূত ইয়াও ওয়েন জানান, আন্তর্জাতিক নিয়ম-নীতি ও জাতিসংঘ সনদ অনুযায়ী কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশের হস্তক্ষেপ করা অনুচিত। তারও আগে, জুনের মাঝামাঝি সময়ে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ওয়াং ওয়েনবিন ‘জাতিসংঘ সনদ’ মেনে ‘আধিপত্যবাদ ও ক্ষমতার রাজনীতির বিরুদ্ধে’ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর কথা জানান। যদিও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে চীন ‘হস্তক্ষেপ করবে না’ বলে আসছে বারবার।
কেবল চীন নয়, বাংলাদেশের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে পশ্চিমা কূটনীতিকদের দৌড়ঝাঁপকেও ইতিবাচকভাবে নেয়নি রাশিয়া। বাংলাদেশের রুশ দূতাবাস গত বছরের ২০ ডিসেম্বর এক বিবৃতিতে ১৯৬৫ সালের জাতিসংঘের ঘোষণার কথা তুলে ধরে ‘কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বা বাহ্যিক যা-ই হোক না কেন, প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করার অধিকার অন্য কোনো রাষ্ট্রের নেই’—এই নীতির কথা মনে করিয়ে দেয়। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে (বিশেষত, স্নায়ুযুদ্ধ শেষের পর থেকে) হস্তক্ষেপ না করার নীতিটি প্রায় লঙ্ঘন করা হচ্ছে। বিশেষত যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমারা মনে করে, নিজেদের স্বার্থে ওই নীতি লঙ্ঘন করা যায়।
রুশ দূতাবাস আরও বলেছে, যেসব দেশ নিজেদের বিশ্বের শাসক বলে মনে করে, তারা ‘গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের’ অজুহাতে নিজেদের মত ও সিদ্ধান্ত বিভিন্ন দেশের ওপর চাপিয়ে দিতে চায়। এর পরিণতিতে স্থিতিশীলতার পরিবর্তে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলে নৈরাজ্যের পরিস্থিতি দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ইস্যুতে পশ্চিমা বিশ্ব এবং চীন-রাশিয়ার অবস্থান যে বিপরীত মেরুতে তা আর অস্পষ্ট কোনো বিষয় এক নয়। এমন পরিস্থিতিতে মস্কোর আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা সম্মেলনে বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার বিষয়টি অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আগের দুই বছরও বাংলাদেশ এই সম্মেলনে যোগ দিয়েছে। গতবারের মতো এবারো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক এতে যোগ দেন।
রাশিয়া বাংলাদেশের ছোট বাণিজ্যিক অংশীদার হলেও চীন মোটেও ছোট আকারের নয়। ২০২২ সালে বাংলাদেশে যে পরিমাণ সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে সেখানে তালিকার দ্বিতীয়তে আছে চীন। ২০২২ সালে চীন বাংলাদেশে ৪৬৫ দশমিক ১৭ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। যা মোট সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের সাড়ে ১৩ শতাংশ। দেশটি বাংলাদেশের সামরিক খাতের অন্যতম বড় সরবরাহকারী দেশ। বাংলাদেশের নৌবহরে থাকা দুটি সাবমেরিনই চীন থেকে কেনা। এমনকি কক্সবাজারে শেখ হাসিনা নৌঘাঁটিও চীনেরই করে দেওয়া। এর বাইরেও চট্টগ্রাম এবং মোংলা বন্দরের উন্নয়নকাজে চীনের অংশগ্রহণ রয়েছে। দেশের সবচেয়ে বড় অবকাঠামো পদ্মা সেতু চীনের সহায়তায় নির্মিত হয়েছে। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চীনের হিস্যা একেবারে সামান্য নয়।
তবে বাংলাদেশে বিনিয়োগ এবং বৈদেশিক সহায়তার ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র এখনো এককভাবে শীর্ষে। ২০২২ সালে দেশে যত সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে তার ১৯ দশমিক ২ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রের। দেশটি সে বছর বাংলাদেশে ৬৬১ দশমিক ১২ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিল। এর বাইরেও কোভিড মহামারির সময় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি ভ্যাকসিন দিয়ে সহায়তা করেছিল। সম্প্রতি বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার ডি হাস বাংলাদেশের একটি সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, স্বাধীনতার পর থেকে বর্তমান পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকার সমান সহায়তা দিয়েছে।
বাংলাদেশ-চীন সম্পর্ক মূল্যায়ন করতে গিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, বাংলাদেশের জন্য যা কিছু গুরুত্বপূর্ণ সে সবই এই সম্পর্কের ভিত্তি হওয়া উচিত। চীন, যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ বেশ ভালোভাবে এই সম্পর্কগুলো রক্ষা করেছে। বাংলাদেশ সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে নিজের পছন্দ বেছে নেওয়ার সক্ষমতা যেন বজায় রাখতে পারে।
তবে এসব কূটনৈতিক কৌশলী মন্তব্য বাদ দিলে আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানের কারণে বাংলাদেশের উপর যুক্তরাষ্ট্র যে চাপ অব্যাহত রাখতে চায় তা কর্মকান্ডে স্পষ্ট। তবে বিশ্ব রাজনীতিতে দেড় দশক আগেও যুক্তরাষ্ট্রের যে প্রভাব ছিল ততটা এখন আর নেই। যদিও সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের তৎপরতা বেড়েছে। এরই মধ্যে বাংলাদেশ সফর করে গেছে ডোনাল্ড লু, উজরা জেয়া, রিচার্ড নেফিউ এবং দুই কংগ্রেসম্যানসহ একাধিক শীর্ষ মার্কিন কর্মকর্তা। পিটার হাস নিজেও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথা বলছেন। এর সবচেয়ে বড় উদ্দেশ্য- নির্বাচন ঘিরে বাংলাদেশকে মার্কিন বলয়ে নিয়ে যাওয়া।
কিন্তু বাংলাদেশের পক্ষে কোনো নির্দিষ্ট বলয়ে যাওয়ার মতো পরিস্থিতি নেই। আমদানি নির্ভর হওয়ায় ও সামরিক খাতে নিজস্ব শিল্প বিকশিত না হওয়ায় বাংলাদেশ বিভিন্ন দেশের ওপরই নির্ভরশীল। ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে নিরবচ্ছিন্ন অর্থনৈতিক উন্নয়ন জরুরি। এসব নিশ্চিত করতে পশ্চিমাদের বিশ্ব ব্যাংক-আইএমএফের সঙ্গে যেমন সম্পর্ক রাখছে তেমনিন চীনা নেতৃত্বের নিউ ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক, এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকেরও সদস্য হয়েছে বাংলাদেশ। এছাড়া উদীয়মান দেশগুলোর জোট ব্রিকসের সদস্য হতে বাংলাদেশ আবেদন করে রেখেছে। তবে ‘যুক্তরাষ্ট্র বিরোধী জোটে পরিণত হওয়ার ভয়ে’ ভারত এর সম্প্রসারণ চায় না। তার সঙ্গে যোগ দিয়েছে ব্রাজিলও।
এমন পরিস্থিতিতে একাদশ মস্কো জাতীয় নিরাপত্তা সম্মেলনে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল মূলত ‘বহুমেরুর বিশ্ব ব্যবস্থা’ এবং ‘এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের নিরাপত্তা’। আলোচনার বিষয়বস্তু থেকে স্পষ্ট, যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে পশ্চিমা প্রভাব বলয়ের বাইরে নতুন বলয় সৃষ্টিতে নাছোড়বান্দা রাশিয়া। এই সম্মেলনে চীন যোগ দেওয়ার মাধ্যমে মূলত রাশিয়ার অবস্থান সমর্থন করেছে।
এই সম্মেলনে সম্ভবত সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই লাভরভ। ‘পশ্চিমা বিশ্বের তৈরি করা উন্নয়ন বোঝাপড়ার বাইরে বিকল্প উন্নয়নের ধারণা এবং নতুন ধরনের সহযোগিতার ক্ষেত্র তৈরি করে বহুপক্ষীয় সম্পর্ক গড়ে তোলার’ বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘বিশ্বে একটি মাত্র দেশ বা একদল দেশের প্রভাব বিস্তারের যে সম্ভাবনা ছিল তা এরই মধ্যে শূন্যে মিলিয়ে গেছে’। লাভরভের এই বক্তব্য এবং উন্নয়নের নতুন ধারণা প্রবর্তনের যে প্রচেষ্টা তা নিঃসন্দেহে যুক্তরাষ্ট্র এবং পশ্চিমা বিশ্বকে বাইপাস করার চেষ্টা।
বাংলাদেশ এই প্রেক্ষাপটে চূড়ান্ত কোনো অবস্থান নেবে কিনা- তা দেখার বিষয়। তবে সম্মেলনের ‘এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগর অঞ্চলের নিরাপত্তা’ শীর্ষক এক প্লেনারি সেশনে প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা বলেছেন, ‘রাশিয়ার ওপর আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলে দুঃখ-দুর্দশা ডেকে এনেছে। এটি অবশ্যই একটি অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি’।
তিনি আরো বলেন, ‘এই পরিস্থিতির কারণেও আমাদের দেশ বড় ধরনের সংকটের মধ্যে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে এসে আমাদের কাছে এটি পরিষ্কার যে, নিষেধাজ্ঞা কারোরই উপকারে আসবে না এবং আমরাই এর প্রধান ভুক্তভোগী’।
ইউক্রেন যুদ্ধের পর জ্বালানি সংকট ও চীন-যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধের কথা তুলে ধরে ‘ভূ-রাজনীতি নিয়ে বৈরিতা’র ছাপিয়ে সুষম অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ‘নিরাপত্তা কাঠামো’ গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
সম্মেলনে তারিক আহমেদ সিদ্দিক যা বলেছেন তা বাংলাদেশের জন্য ভারসাম্যমূলক অবস্থান ব্যক্ত করে। একই সঙ্গে তা আঞ্চলিক রাজনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণও বটে। তবে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, চীন এবং অন্যান্য উদীয়মান দেশগুলো যেভাবে নিজেদের প্রভাব বিস্তারের খেলা নেমেছে সেখানে ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থান বজায় রাখাই যথেষ্ঠ চ্যালেঞ্জের। বাংলাদেশ আগামি জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে কীভাবে ভূরাজনৈতিক অঙ্কের জটিল সমীকরণ ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করবে- সেটাই দেখার অপেক্ষা। তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, তাস, আরটি এবং রয়টার্স

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ