দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন বুশরা বিনতে বাতেন। সম্প্রতি অসুস্থ হয়ে তার শ্বশুর এবং শাশুড়ি দুজনই একদিনের ব্যবধানে মারা যান। বাসায় অসুস্থ হবার পরে এ দু’জনকে হাসপাতালে ভর্তি করাতে রীতিমতো বেগ পেতে হয়েছে মিস্ বাতেন এবং তার পরিবারকে। একজন সাধারণ রোগী হিসেবে কোনো হাসপাতালেই রোগী ভর্তি করানো সম্ভব হয়নি। পরিচিত ব্যক্তিদের মাধ্যমে যোগাযোগ করে এ কাজ সমাধান করতে হয়েছে।
বুশরা বিনতে বাতেন জানান, ‘উনাদের যে কয়েকটা হাসপাতালে ভর্তি করেছি, প্রতিটি জায়গায় রেফারেন্সের মাধ্যমে যেতে হয়েছে। কোনো হাসপাতালে সরাসরি গিয়ে আমরা সেবা পাইনি। আমরা ১০ দিনের মধ্যে চারটা হাসপাতালে নিয়ে গেছি। প্রতিটি হাসপাতালে যাবার আগে আমাদের একটা রেফারেন্স লেগেছে’।
বাংলাদেশের সমাজে ক্ষমতাবান না হলে সাধারণ মানুষের পক্ষে যে কোনো সেবা পাওয়া দুষ্কর। বুশরা বিনতে বাতেনের পরিবার এর একটি উদাহরণ মাত্র। এই ক্ষমতা বিভিন্ন ধরণের হতে পারে। রাজনৈতিক ক্ষমতা, বিত্তশালী হবার ক্ষমতা এমনকি ঊর্ধ্বতন সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা হবার ক্ষমতা। করোনা ভাইরাস মহামারির এ সময়টিতে ক্ষমতার জোর আরো প্রকট ও দৃশ্যমান হয়ে উঠেছে।
সব জায়গায় ‘ভিআইপি’ দাপট
ঢাকার আরেক বাসিন্দা ইয়াসমিন ইতি জানান, দেশের ভেতরে তথাকথিত ভিআইপি সংস্কৃতির কারণে সাধারণ মানুষের জীবন দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে। নিজের একটি অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে ইতি বলেন, অতি নগণ্য বিষয় নিয়েও তথাকথিত ভিআইপি এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে পার্থক্য তৈরি করা হয়। আমি একবার নওগাঁর আত্রাই এলাকায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি কাছারি বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম। সেখানে আমি দর্শণার্থী হিসেবে টিকিট কেটে ঢুকে ঘুরছিলাম। এমন সময় সিকিউরিটি গার্ডরা দৌড়ে এসে বললো, অমুক সাংসদ এসেছে তার আত্মীয়-স্বজন নিয়ে, এখন সাধারণ যারা আছে তাদের বাইরে অপেক্ষা করতে হবে। সাংসদ ঘুরে চলে গেলে আপনারা আবার ঢুকতে পারবেন। খুব অপমাণিত বোধ করেছি তখন।
এয়ারপোর্ট, পাসপোর্ট অফিস, ট্রেন, বিমান, লঞ্চ- সব জায়গাতেই তথাকথিত ভিআইপি কালচারের চর্চা চোখে পড়ার মতো। ক্ষমতার সাথে যারা নানাভাবে সম্পৃক্ত তারা নিজেদের সুবিধার জন্য আলাদাভাবে লিখিত কিংবা অলিখিত একটি সিস্টেম চালু করেছেন, যেটি সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা। বাংলাদেশের রাষ্ট্রব্যবস্থায় তথাকথিত এই ভিআইপি সংস্কৃতিকে সযত্নে লালন করা হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক ও বিশ্লেষক গোবিন্দ চক্রবর্তী ব্যাখ্যা করছিলেন এই সংস্কৃতি দিনকে দিন কেন শক্তিশালী হয়ে উঠছে? গোবিন্দ চক্রবর্তী বলেন, রাষ্ট্র ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত কিছু পকেটস আছে। এগুলো বিভিন্ন শাসনামলে শক্তিশালী হয়েছে। আমাদের এখানে নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে এলিটরা যেটা প্রেফার করে, শেষ পর্যন্ত সেটাই বাস্তবায়ন হয়। বাংলাদেশের নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ইন্টারেস্ট গ্রুপ বেশ শক্তিশালী। যারা নীতি প্রণয়ন করছেন, তারা এই গ্রুপগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বাজায় রাখার চেষ্টা করছেন।
বাংলাদেশে যে কোনো সরকারি সেবা যথাসময়ে পাওয়ার ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষকে যখন সংগ্রাম করতে হয়, তখন ক্ষমতাবান এবং বিত্তবানদের জন্য সেটি বেশ অনায়াসে হয়ে যায়। অনেকক্ষেত্রে তাদের সশরীরে উপস্থিতও হতে হয় না। রাজনীতিবিদ এবং বিত্তশালী ব্যবসায়ী ছাড়াও ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত থাকেন সামরিক এবং বেসামরিক কর্মকর্তারা।
সাবেক সচিব শফিক আলম মেহেদির কাছে জানতে চাওয়া হয়- বিভিন্ন ক্ষেত্রে কেন সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা করা হয়? উত্তরে তিনি বলেন, সরকারি কাজের প্রয়োজনে কিছু সুবিধা চালু করা হয়েছে। এর বাইরে অন্য কিছু দাবি করার সুযোগ নেই। আমরা যখন জয়েন্ট সেক্রেটারি হলাম তখন বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে গেলে সেখানে একটা আসন সংরক্ষিত থাকতো। এছাড়া সচিব যখন হলাম তখন একটি ডিপ্লোম্যাটিক পাসপোর্ট পেয়েছি। এটা সরকারি কাজের সুবিধার্থে।
মহামারির সময় ভিআইপি সংস্কৃতি প্রকট হয়েছে
দেশের ভঙ্গুর চিকিৎসা ব্যবস্থাতে এমনিতেই বৈষম্য ছিল। কিন্তু এবার সেটি আরো প্রকট হয়েছে। মহামারির এই সময়টিও বাংলাদেশের তথাকথিত ভিআইপি সংস্কৃতি বা বিশেষ সুবিধা পাওয়ার সংস্কৃতিতে কোনো পরিবর্তন আনতে পারেনি। ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তি, বিত্তশালী ব্যবসায়ীরা সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছেন। যেখানে সাধারণ মানুষের কোনো প্রবেশাধিকার সীমিত। ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত কাউকে-কাউকে ঢাকার বাইরে থেকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে ঢাকায় এনে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অবশ্য রোগীর চাপ এতোটাই বেশি যে ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত সবাই সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে পারেননি। খবর বিবিসি বাংলার
করোনা ভাইরাস মহামারির সময় হাসপাতালে সাধারণ মানুষের জায়গা পেতে বেশ সংগ্রাম করতে হয়েছে। মানবাধিকার কর্মী নীনা গোস্বামী বলেন, সুযোগ সুবিধা যেখানে খুবই অপ্রতুল সেখানে মহামারির সময় পরিস্থিতির কোনো বদল আশা করা যায় না। স্বাস্থ্যখাতের অব্যবস্থাপনা যখন সামনে চলে আসছে তখন তাদের মনে একটা ভয় কাজ করে। যারা ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্ত থাকে তারা সর্বোচ্চ সুবিধাটা নিতে চায়। সেখানে ইকুয়ালিটির প্রশ্নই আসে না। এটা শুধু মহামারির সময় না, ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্তরা সবসময় সুবিধা পেয়ে থাকে। আপনি সাধারণ সময়েও দেখবেন যে, কিছু মানুষ চিকিৎসার জন্য হেলিকপ্টারের সুবিধা পায়। আবার বাইরে চলে যাবার জন্যও বিশেষ সুবিধা পায়।
শুধু হাসপাতালে চিকিৎসা নয়, করোনা ভাইরাসের টেস্ট করানোর ক্ষেত্রেও বৈষম্য চোখে পড়ে। অভিযোগ রয়েছে টেস্ট-এর ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা অগ্রাধিকার পায়। এছাড়া সাংবাদিক, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশাজীবী গ্রুপ তাদের সংগঠনের সদস্যদের জন্য আলাদা টেস্ট করার ব্যবস্থা করিয়ে নিয়েছেন।
অন্যদিকে সাধারণ মানুষ করোনা ভাইরাসের টেস্ট করানোর জন্য রীতিমতো গলদঘর্ম হচ্ছেন। ঢাকার বাসিন্দা প্রিয়াঙ্কা ভট্টাচার্য বলেন, করোনা ভাইরাস সংক্রমণের সব উপসর্গ থাকা সত্ত্বেও টেস্ট করাতে তাকে দু’সপ্তাহ অপেক্ষা করাতে হয়েছে। শেষ পর্যন্ত এক আত্মীয়ের পরিচয়ের মাধ্যমে সেটি করানো সম্ভব হয়েছে। পরিচিত না থাকলে মনে হয় সম্ভব হতো না।
ভিআইপি সংস্কৃতির মূলে রয়েছে রাজনীতি
সরকারি যে কোনো সেবা পেতে সাধারণ মানুষকে বহু কষ্ট করতে হয়। বিশ্লেষকরা মনে করেন, তথাকথিত এই ভিআইপি সংস্কৃতির পরিবর্তন করতে পারতো রাজনীতি এবং রাজনীতিবিদরা। কিন্তু তারাও যেহেতু এই সুবিধা অংশ পায় সেজন্য এটি পরিবর্তনে তাদেরও কোনো আগ্রহ নেই।
গত প্রায় ৪০ বছর যাবত রাজনীতির সাথে যুক্ত আছেন নূহ-উল-আলম লেনিন। এক সময় কমিউনিস্ট পার্টি করলেও দীর্ঘদিন আওয়ামী লীগের সাথে তিনি যুক্ত। তিনি মনে করেন, তথাকথিত ভিআইপি সংস্কৃতি টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের আগ্রহই সবচেয়ে বেশি। তিনি মনে করেন, প্রায় সোয়া ২০০ বছর আগে এই অঞ্চলে ব্রিটিশদের চালু করা জমিদারি প্রথার ধারাবাহিকতায় বর্তমানের ভিআইপি কালচার চালু রয়েছে। লেনিন বলেন, ভিআইপি এবং ভিভিআইপি- এই সিস্টেম অফিসিয়ালি কে করেছে? এটা করেছে রাষ্ট্র। রাষ্ট্র যেহেতু চিরকালই অভিজাত শ্রেণির হাতে ছিল, সে কারণেই এটা অতীতের ধারাবাহিকতায় চলে এসেছে। তিনি মনে করেন, ক্ষমতাবানরা নিজেদেরকে অন্যদের চেয়ে আলাদা হিসেবে তুলে ধরতে চান। সেজন্যই ভিআইপি কালচার এখনো লালন করা হচ্ছে। ক্ষমতার একটা ক্যারেক্টার থাকে। ক্ষমতা যদি প্রয়োগ করা এবং সে যদি নিজেকে সাধারণ মানুষের চেয়ে আলাদা করতে না পারে, তাহলে সে কিসের ক্ষমতাবান হলো?
বিশ্লেষকরা বলেন, যেখানে জনসংখ্যার তুলনায় সুযোগ-সুবিধা খুবই অপ্রতুল সেখানে দ্রুত সেবা পেতে তথাকথিত ভিআইপি সংস্কৃতি টিকে থাকবে। আবার অনেকে মনে করেন, ক্ষমতার সাথে সম্পৃক্তরা যেহেতু আলাদা সুবিধা পান, সেজন্য সিস্টেমের পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে তাদের তেমন একটা মনোযোগও দেখা যায়না।
ডিসি/এসআইকে/এমএসএ