ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি >>>
এতোদিন দেশের বিভিন্ন প্রান্তে সরকার কর্তৃক বিনামূল্যে দেশের অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষদের জন্য বরাদ্দকৃত রেশন কার্ড (বিশেষ ওএমএস কার্ড) করে দেয়ার কথা বলে টাকা নেয়ার অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। এবার এই রকম ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেলে খোদ চট্টগ্রাম নগরে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন এলাকার পাহাড়তলীস্থ ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডে এমন ঘটনা ঘটেছে। ১০ টাকায় চাউলসহ একেবারে কমদামে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য পেতে সরকারি ওএমএস কর্মসূচির যে রেশন কার্ড দেয়া হয়েছে তা করে দিতে মানুষদের কাছ থেকে জনপ্রতি ৩০০ টাকা করে নেয়ার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
জানা গেছে, চলমান করোনা প্রাদুর্ভাবের কারণে সম্প্রতি সরকার সারাদেশে বিশেষ কর্মসূচি ওএমএস কার্যক্রম আরো জোরদার করে। সে লক্ষ্যে নতুন করে আরো ৫০ লক্ষ সাধারণ মানুষকে ওএমএস কর্মসূচির আওতায় আনতে রেশন কার্ড তৈরির দায়িত্ব দেয় সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিদের। সে ধারাবাহিকতায় চট্টগ্রামে এই রেশন কার্ড তৈরির দায়িত্ব পায় সিটি কর্পোরেশন তথা ওয়ার্ড কাউন্সিলররা। চাহিদা ও জনসংখ্যা ও অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় ওয়ার্ডে নির্দিষ্ট সংখ্যক রেশন কার্ড তৈরি শুরু করেন স্থানীয় কাউন্সিলরেরা। তারা তাদের সমর্থক, অনুগামী, দলীয় নেতা ও কর্মীদের জন্যও কোটা অনুকরণে রেশন কার্ড তৈরির কাজ দেন। ফলে ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়ে সব ওয়ার্ডেই ইতোমধ্যে ওএমএস কার্ড এর তালিকা তৈরি করে কাউন্সিলরকে দেন দায়িত্বপ্রাপ্তরা। পরে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে জমা দেন কাউন্সিলরেরা। তার ভিত্তিতে কাউন্সিলররা সরকার থেকে রেশন কার্ড পান যা ইতোমধ্যে বিতরণ করা হয়েছে।
কিন্তু চট্টগ্রাম নগরের ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডে টাকার বিনিময়ে রেশন কার্ড করে দেয়ার গুরুতর অভিযোগ উঠতে থাকে। গত বেশ কিছুদিন ধরে এ তথ্য পুরো ওয়ার্ডেই ছড়িয়ে পড়ে। একটি সূত্র মারফত দৈনিক চট্টগ্রাম এ সংক্রান্ত কিছু অভিযোগ ও সংশ্লিষ্ট কিছু ডকুমেন্টস পায়। পরে সেই সূত্র ধরে দৈনিক চট্টগ্রাম সরেজমিনে যাচাই করে অভিযোগের সত্যতা পায়। জানা যায়, সরাইপাড়া ওয়ার্ডের আলোচিত ও সমালোচিত কাউন্সিলর ছাবের আহম্মদ সওদাগরের অনুগামি সমর্থক মো. তারেক (২৫) নামের এক যুবক কাউন্সিলর কর্তৃক ১০ জনকে রেশন কার্ড করে দেয়ার দায়িত্ব পান। তিনি (তারেক) তার নিজ বাড়ি সরাইপাড়া ওয়ার্ডের পদ্মপুকুরপাড়স্থ মাওলানা মোস্তফা বাড়ির বেশ কয়েকজন নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের কাছ থেকে রেশন কার্ড করে দেয়ার জন্য ৩০০ টাকা করে নেন। কিছু কিছু পরিবারের কাছ থেকে ১৫০-২০০ টাকাও নেন। কাউন্সিলরের দেয়া ১০টি কার্ডের বাইরেও অনেককে নিজের ক্ষমতাবলে রেশন কার্ড (ওএমএস) করিয়ে দেয়ার কথা বলেও টাকা নেন তারেক। কিন্তু টাকা দেয়া মানুষদের অধিকাংশই রেশন কার্ড পাননি। কেউ কেউ পেলেও অন্য আরেকজনের মাধ্যমে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। মাওলানা মোস্তফা বাড়ির যাদের কাছ থেকে টাকা নেয়ার সত্যতা পাওয়া গেছে তাদের মধ্যে ওই বাড়ির তাজুল ইসলাম, নাসিমা আকতার, ফাতেমা বেগম, রুবেল, তালেব, ফেরদৌস, দিল মোহাম্মদ, রিনা বেগম, মো. আরিফ, কামরুন্নাহার ববি, বাবুল, করিম, শান্তা বেগম, শাহ আলম, সুলতান আহম্মেদ, আব্দুল আজিজ উল্লেখ্যযোগ্য। তবে ঘটনা ফাঁস হয়ে যাওয়ার পর থেকে টাকা দেয়া মানুষদের ঘরে ঘরে গিয়ে এই বিষয়ে কাউকে কিছু না বলতে হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে উল্লেখিতদের অনেকে জানান। কাউকে ফোন করে, কাউকে বাসায় গিয়ে, কাউকে অন্যদের দিয়ে এসব হুমকি দেয়া হচ্ছে বলে জানা গেছে। হুমকি দেয়া কয়েকটি অডিও রেকর্ডও দৈনিক চট্টগ্রামের হাতে এসেছে। এছাড়াও টাকা দিতে রাজি না হওয়ায় রেশন কার্ড পেতে কয়েকজনের তথ্যও গ্রহণ করেনি তারেক ও কাউন্সিলরের লোকেরা- এমন অভিযোগও পাওয়া গেছে।
রেশন কার্ড পেতে তারেকের চাহিত টাকা দেয়া এক নারী জানান, আমার কাছ থেকে ভোটার আইডি কার্ড, টাকা ও ছবি নিছে। বলছে সরকার কার্ড দিতেছেতো ৩-৪০০। এখানে কার্ড দরকার অনেক। আমারতো কার্ড খুব দরকার। তারেক বলছে প্রতিযোগিতা করে প্রভাবখাটিয়ে রেশন কার্ড নিয়ে দিবে। সে জন্য ৩০০ টাকা লাগবে। আমার যেহেতু খুব দরকার। তাই টাকা দিছি। কিন্তু এখনও পাইনি।
টাকা দেয়া আরেকজন (পুরুষ) জানান, কি করবো ভাই। এলাকার ছেলে। কাউন্সিলরের সাথে সম্পর্ক ভালো তার। বলছে টাকা দিলে কার্ড অবশ্যই করে দিতে পারবে। কিন্তু পাইলাম নাতো।
মো. তারেক স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের ক্যাডার হিসেবেই বেশ পরিচিত। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের স্থানীয় এক নেতাকে পিটিয়ে হত্যার দায়ে দায়েরকৃত মামলার প্রধান আসামি কাউন্সিলর ছাবের আহম্মেদ। ওয়ার্ডে নিজের ক্ষমতার পরিধি বাড়াতে গিয়ে তিনি এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এজন্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ এবার তাকে মনোনয়ন না দিয়ে দলের ওয়ার্ড কমিটির আহবায়ক মো. নুরুল আমিনকে মনোনয়ন দেয়। ফলে বিদ্রোহীপ্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে থেকে যান ছাবের আহম্মেদ। নির্বাচনী প্রচারণার সময় সরকারসমর্থক কাউন্সিলরপ্রার্থী নুরুল আমিনের উপর কাউন্সিলরের ছেলে অপুর নেতৃত্বে হামলা হয়। এ নিয়ে মামলাও হয়। সেই হামলার মামলায়ও এই অভিযুক্ত তারেক ৭ নম্বর আসামি। মূলত এই ঘটনার পর থেকেই কাউন্সিলর ছাবের সওদাগরের সাথে উঠতি ক্যাডার বলে খ্যাত তারেকের সখ্যতা বাড়ে। এরপর থেকেউ কাউন্সিলরের হয়ে বিভিন্ন কাজে তিনি যুক্ত হন। তার বিরুদ্ধে কিশোর গ্যাং চালানোসহ বেশকিছু চাঁদাবাজির মামলাও আছে বলে জানা গেছে। এছাড়াও চাঁদাবাজি করতে গিয়ে মারামারি এবং তার পরবর্তী বিচারসালিশে মুচলেকা দেয়ার ঘটনাও আছে বলে জানা গেছে।
টাকার বিনিময়ে সাধারণ মানুষকে রেশন কার্ড করিয়ে দেয়া প্রসঙ্গে জানতে চাইলে অভিযুক্ত মো. তারেক (২৫) দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, অভিযোগ পুরোপুরি মিথ্যা। রাজনৈতিক কারণে এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক বিরোধের জেরে আমার বিরুদ্ধে এসব রটানো হচ্ছে। এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের বাড়িতে বিচার-সালিশও হচ্ছে।
তবে মাওলানা মোস্তফা বাড়িতে এই বিষয়ে কোনো বিচার-সালিশ হচ্ছে না জানিয়ে এই বাড়িতে কাউন্সিলর কর্তৃক নিয়োগকৃত পঞ্চায়েত কমিটির সদস্য (মেম্বার) মো. হামিদ দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, আমাদের বাড়ির মানুষদের ওএমএস এর পণ্য কেনার জন্য সরকারের বিনামূল্যের রেশন কার্ড পাইয়ে দিবে বলে তারেক অনেকের কাছ থেকেই টাকা নিয়েছে। আমিও বিষয়টির প্রমাণ পেয়েছি। তিনি বলেন, এখানে রাজনৈতিক কারণে গুজব ছড়ানো হচ্ছে বলা হচ্ছে। কিন্তু এই ঘটনা গুজব না, সত্য। তিনি বলেন, আমি নিজেও আওয়ামী লীগ করি। আমার দল দেশের মানুষের জন্য ভালো ভালো উদ্যোগ নিচ্ছে। এরকম কিছু অপকর্মের জন্য দলের দুর্নাম হচ্ছে। তিনি বলেন, ছেলেটা কাউন্সিলরের আশকারা, দলের কয়েকজনের আশকারায় এই ধরণের কাজ করতে উৎসাহিত হয়েছে। এই বিষয়ে আমি কাউন্সিলরকেও জানিয়েছি। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এটা নিয়ে বিচার-সালিশ হচ্ছে- অভিযুক্ত তারেকের এই কথার কোনো সত্যতা নেই জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের বাড়িতে এ বিষয়টি নিয়ে কোনো সালিশ হওয়ার বিষয়ে আমি অবগত নই। কোনো বিচার-সালিশ হয়নি বলেও জানান তিনি
মাওলানা মোস্তফা বাড়ির অধিবাসী মো. মোরশেদ দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, সরকার বরাদ্দকৃত বিনামূল্যের রেশন কার্ড যা দিয়ে মধ্যবিত্ত বা অর্থনৈতিকভাবে একটু অসচ্ছল যারা তারা ১০ টাকায় চাউলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য একেবারে কমদামে কিনতে পারেন। কিন্তু সরকারের এই ভালো উদ্যোগ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। এখন একটা দুর্যোগ চললেও এই দুর্যোগেও কিছু নেতা-কর্মী এগুলোকে টাকা কামানোর পথ হিসেবে ব্যবহার করছে। তিনি বলেন, আমি মাওলানা মোস্তফা বাড়ির বাসিন্দা। আমার এই বাড়ির অনেকের কাছ থেকেই তারেক ৩০০ টাকা করে নিয়েছে। বিষয়টি জানাজানি হওয়ার পর সে টাকা যারা দিয়েছে তাদের হুমকি দিচ্ছে। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেতো আমরা এগুলো আশা করি না।
স্থানীয় কাউন্সিলর ছাবের আহম্মদ সওদাগর দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, আমি অভিযোগ সম্পর্কে জেনেছি। তবে তা তদন্ত করে কোনো সত্যতা পাইনি। তিনি বলেন, মো. তারেক আমার অনুসারি। আমি তাকে তার এলাকার ১০ জন দরিদ্র মানুষকে ওএমএস কার্ড (রেশন কার্ড) করে তাদের সরকারি সেবার আওতায় আনার জন্য ১০টি কার্ড দিয়েছি। কিন্তু প্রতিটি কার্ডের বিপরীতে সে টাকা নিয়েছে বলে যে অভিযোগ আনা হচ্ছে তার সত্যতা আমি পাইনি। আমি দু’জন নারীকেও ডেকে এনে সামনাসামনি জিজ্ঞেস করেছি। তারা জানিয়েছে তারা তারেককে রেশন কার্ডের জন্য কোনো টাকা দেননি এবং তারেক চায়ওনি। তারা একটি অনলাইন টিভিকে সাক্ষাৎকারে কেন তাহলে বলেছেন সেটিও জিজ্ঞেস করেছি। তারা বলেছেন- জিজ্ঞেস করছিল তাই বলছি।
সরাইপাড়া ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের একাধিক দায়িত্বশীল নেতা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত বলে জানিয়েছেন। এর সত্যতাও তারা পেয়েছেন বলে জানালেও এই বিষয়ে কোনো মন্তব্য করবেন না বলে তারা জানিয়েছেন। তারা বলেছেন- এটা দলের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হচ্ছে। যেহেতু ছেলেটা দলের কেউ না। কাউন্সিলরের অনুগামী ও ক্যাডার, সে জন্য এই দায়িত্ব কাউন্সিলরের উপরই বর্তায় বলে তারা জানান।
ডিসি/এসআইকে/আইএস