বাংলাদেশে জঙ্গি তৎপরতার আশঙ্কা!

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
আফগানিস্তানে তালেবানের উত্থানে বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদ ও জঙ্গি গোষ্ঠীর তৎপর হয়ে ওঠার আলোচনা সামনে এসেছে। এ বিষয়ে দীর্ঘদের অভিজ্ঞতা থেকে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকেই।
এই আশঙ্কার পেছনে রয়েছে অতীতের অভিজ্ঞতা এবং বর্তমান প্রেক্ষাপট। ২০ বছর আগে তালেবানরা যখন আফগানিস্তানে ক্ষমতায় ছিলো, তখন এবং তার আগে ও পরের বিভিন্ন সময় বাংলাদেশে ধর্মীয় উগ্রবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা ছিল। পাশাপাশি বর্তমানে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা দৃশ্যমান না থাকলেও সাম্প্রতিক বেশ কিছু ঘটনা এই আশঙ্কার পেছনে প্রধান কারণ।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, আশির দশকে আফগানিস্তানে যখন এই ধর্মীয় উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর তৎপরতা শুরু হয়, তার পর থেকেই বাংলাদেশেও এর প্রভাব পড়তে থাকে। ওই সময় আফগানিস্তানে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত কমিউনিস্ট সরকারের বিরুদ্ধে মুজাহিদিন বাহিনী যুদ্ধ শুরু করে। তখন আফগান সরকারের সমর্থনে সোভিয়েত ইউনিয়ন সৈন্য পাঠায়। মুজাহিদিন বাহিনীর পক্ষ নিয়ে সোভিয়েত বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে বাংলাদেশ থেকে অনেক লোক তখন আফগানিস্তানে যায়। প্রকৃত হিসাব না পাওয়া গেলেও কয়েক হাজার লোক সেখানে গিয়েছিলো বলে বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়। সোভিয়েত বাহিনী ফিরে যাওয়ার পর মুজাহিদিনরা ক্ষমতা নেয়। কিন্তু তারপরই মুজাহিদিনের মধ্যে থেকেই সৃষ্ট সংগঠন তালেবানের হাতে ক্ষমতা চলে যায়। বাংলাদেশ থেকে যারা সেখানে যায় তারা তালেবানের পক্ষ নিয়েও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
ওই বিশ্লেষকরা জানান, আফগান যুদ্ধে যারা অংশ নিয়েছিলো তারা দলে দলে বিভিন্ন সময় দেশে ফিরে এসে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন গড়ে তোলেন। কোনো কোনো সংগঠন প্রকাশ্যে জঙ্গি তৎপরতাও শুরু করে এবং দেশের মধ্যে একের পর এক বিভিন্ন সন্ত্রাসী ঘটনা ঘটতে থাকে। আবারও তালেবান সেখানে ফিরে আসায় এখানেও জঙ্গি গোষ্ঠী তৎপর হয়ে ওঠার অপচেষ্টা চালাতে পারে বলে বিশ্লেষকাদের আশঙ্কা।
সরকারের দিক থেকে বলা হচ্ছে, দেশে জঙ্গিবাদ উত্থানের আশঙ্কা নেই। ইতোমধ্যেই জঙ্গি সংগঠনগুলোকে দুর্বল করে ফেলা হয়েছে। তাছাড়া অতীতে যখন দেশে জঙ্গি সংগঠনের জন্ম ও তৎপরতা দেখা যায়, তখন ওই জঙ্গিরা ক্ষমতাসীনদের সহযোগিতা ও রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা পায় বলে সরকার সংশ্লিষ্টরা জানান। বর্তমানে সেই পরিস্থিতি নেই এবং সরকার ও প্রশাসন এদের ব্যাপারে সতর্ক রয়েছে বলেও তারা জানান।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, সরকার জঙ্গি দমন, জঙ্গি সংগঠনকে দুর্বল করার কথা বলছে। কিন্তু জঙ্গি নির্মূল হয়নি। এর পাশাপাশি রয়েছে ধর্মভিত্তিক বিভিন্ন সাম্প্রদায়িক সংগঠন। এ সব সংগঠনের নেতৃত্ব পর্যায়সহ বিভিন্ন পর্যায়ে রয়েছে পূর্বে আফগান যুদ্ধে অংশ নেওয়া ও প্রশিক্ষণ প্রাপ্তরা। সম্প্রতি দেশের মধ্যে ধর্মভিত্তিক এ সব সংগঠনের উগ্র সাম্প্রদায়িক তৎপরতা লক্ষ্য করা গেছে। তালেবানের মতো এরাও শরিয়া আইন জারি করার কথা বলে, এরাও আধুনিকতা, নারী শিক্ষা ও নারী অধিকারের বিরুদ্ধে।
এদিকে তালেবানরা আবার ফিরে আসার পর ইতোমধ্যে বাংলাদেশ থেকে কিছু লোক আফগানিস্তানে গেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। গত ১৪ আগস্ট ঢাকার পুলিশ কমিশনারও এমন মন্তব্য করেছেন। যদিও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পরে এই তথ্য নাকচ করে দেন।
আফগানিস্তানের ঘটনার পর বাংলাদেশে উগ্র সাম্প্রদায়িক জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের আশঙ্কার কারণ ব্যাখা করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির (যিনি দীর্ঘদিন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদ বিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছেন) বলেন, আফগানিস্তানের পরিস্থিতি এখন খুবই ভয়াবহ। আমরা তালেবানের প্রথম শাসন দেখেছি। তখন বাংলাদেশ থেকে সাত হাজারের বেশি মানুষ আফগানিস্তানে গিয়েছিলো তালেবানের পক্ষে যুদ্ধ করতে, প্রশিক্ষণ নিতে। এদের মধ্যে অনেকে যুদ্ধে মারা যায়। দেশে ফেরে পাঁচ হাজার মানুষ। এরা এসে মাদ্রাসাগুলোতে মগজ ধোলাই করেছে। হেফাজতে ইসলামের অনেক নেতা আফগান ফেরত জিহাদি। জামায়াত, হেফাজতসহ ধর্মের নামে বিভিন্ন উগ্র সাম্প্রদায়িক সংগঠন আছে। এদের সঙ্গে বিএনপি রয়েছে। ডা. জাফরুল্লাহ তো বলেই ফেলেছেন, তালেবানকে স্বীকৃতি দিতে হবে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা আর আফগানিস্তানের নজিবউল্লাহকে হত্যা মধ্যে আমি পার্থক্য দেখি না। বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানপন্থিরা হত্যা করেছে, নজিবউল্লাকেও পাকিস্তানপন্থিরা হত্যা করেছে। পাকিস্তান তালেবানকে সহযোগিতা করে আসছে। এদের দর্শন মওদুদীবাদ। আমাদের সরকার যেনো কোনোভাবেই এদের স্বীকৃতি না দেয়। গোটা দক্ষিণ এশিয়া এখন হুমকির মুখে। পাকিস্তান এই তালেবানদের পেট্রোনাইজ করছে, পাকিস্তানের অস্তিত্বও হুমকির মুখে পড়বে। কারণ এরা ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, দানব এরা।
ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার পরামর্শ দিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, তালেবান, জামায়াত, হেফাজতের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। এরা গণতস্ত্র বিরোধী, শরিয়া আইন চায়। হেফাজত নেতা আহমদ শফি তো বলেছিলেন, মেয়েরা চার ক্লাসের ওপরে পড়তে পারবে না। ধর্মের নামে এখানে ১২৫টির মতো সংগঠন আছে। এই তালেবানি রাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে। হেফাজতের সঙ্গে সরকার, আওয়ামী লীগের দহরম-মহরম ছাড়তে হবে, কঠোর অবস্থান নিতে হবে। আশরাফ গনি ইসলামের বিরুদ্ধে ছিলেন না। নজিবউল্লাহ কমিউনিস্ট হয়েও আফগানিস্তানকে ইসলামিক রাষ্ট্রের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কিন্তু রক্ষা হয়নি, তালেবানরা নজিবউল্লাহকে নৃশংসভাবে গাড়ির পেছনে বেঁধে রাস্তায় টেনে এবং বিদ্যুতের খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়েছিলো। আসলে এরা ইসলাম চায় না, এরা চায় মওদুদীর ইসলাম। এরা শরিয়া আইন জারি করবে। এখন হয় তো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য বিভিন্ন কথা বলেছেন। আমাদের দেশেও তো আমরা দেখেছি বিএনপি-জামায়াত যখন ক্ষমতায় ছিলো তখন বাংলা ভাই, তার শরিয়া আদালত। শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে চেয়েছিলো আফগানিস্তানে ট্রেনিং নেওয়া মুফতি হান্নান, মুফতি ইজাহার এখনও ঘুরে বেড়াচ্ছে। এখনই এখান থেকে আফগানিস্তানে যাওয়া শুরু হয়েছে। আমাদের হিসাবে ইতোমধ্যে কয়েক শ’ লোক চলে গেছে। তাবলিগের নামে, নানাভাবে যাচ্ছে। আসলে সরকার তো বলতে চায় না, তারপরও পুলিশ কমিশনার কিছু লোকের যাওয়ার কথা বলেছেন।
তবে এই আশঙ্কা নাকোচ করে দিয়ে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ নেতা খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাসবাদে যারা মদদ দিতো তারা কোণঠাসা। মানুষ এখন উন্নয়ন সমৃদ্ধির দিকে মনোযোগ দিয়েছে। বিকৃত ধর্ম চর্চা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছিলো। তাতে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো। মানুষ এখন বুঝছে উন্নয়ন কি জিনিস। মানুষ আলোর পথে হাঁটছে। এখানে জঙ্গিবাদের আর উত্থান ঘটতে পারবে না, এদেশের মানুষ অন্ধকারে হাঁটবে না। তারপরও কিছু কিছু গোষ্ঠী আছে চেষ্টা করবে, কিন্তু সরকার ও জনগণ সজাগ আছে।
যারা আশঙ্কা করছেন তারা অতীতের জঙ্গি তৎপরতার ঘটনার অভিজ্ঞতা থেকেই মূলত এই আশঙ্কা করছেন যে আবারও জাঙ্গিরা অপতৎপরতা চালানোর চেষ্টা করতে পারে। তবে এ প্রসঙ্গে খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, অতীতে এই উগ্রবাদী গোষ্ঠীর মদদদাতারা ছিলো, রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো। রাষ্ট্র যন্ত্রকে ব্যবহার করে বিএনপি-জামায়াত নিজেদের ক্ষমতা পাকাপোক্ত করতে শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই সৃষ্টি করেছিলো। এখন বিকৃত ধর্ম চর্চা দিয়ে দেশ পরিচালিত হচ্ছে না। মানুষ সঠিকভাবে ধর্ম চর্চা করছে। সন্ত্রাসী জঙ্গি গোষ্ঠীকে দুর্বল করে দেওয়া হয়েছে। অতীতে যেহেতু রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো। তাই এখন এই সন্ত্রাসী জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থানের সুযোগ নেই।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ