ইতিবাচক চিন্তা ভাবনার কৌশল- মো. ইয়াছিন মনজু

                          -: মো. ইয়াছিন মনজু :-

যে চিন্তা করলে ভালো লাগে, শান্তি লাগে, স্বস্তি লাগে, মানুষের উপকার করতে, প্রশংসা করতে, কল্যাণমূলক কাজ করতে ইচ্ছা হয়, আত্মবিশ্বাস জাগ্রত হয়- এমন সব চিন্তাকে ইতিবাচক (Positive) চিন্তা বলে। ইতিবাচক মানসিকতা হলো একটি দক্ষতা যা সামাজিক ও যোগাযোগ দক্ষতা ব্যবহার করে নিজের পক্ষে নেয়া, কিন্তু অন্যের মতামত এবং প্রয়োজনীয সম্মান বজায় রাখা। ইতিবাচক মানসিকতা কেউ জন্মসূত্রেই পায় না। এটি ভাগ্য বা বংশগতিও নয়। বরং এটি একটি অর্জনযোগ্য দক্ষতা যা আপনি চাইলে চর্চার মাধ্যমে বাড়াতে পারবেন।
একটি গ্লাসে যদি অর্ধেকের বেশি পানি থাকে এবং আপনি যদি মনে করেন গ্লাসের খানিক অংশে পানি নেই তাহলে আপনার চিন্তার পরিবর্তন করা জরুরী। গবেষকগণ বলে থাকেন, ইতিবাচক চিন্তা যারা করেন তারা অসুস্থতায় কাবু হয়ে যান না বরং মনের শক্তি দ্বারা নিজেকে শক্ত রাখেন। ইতিবাচক চিন্তার অধিকারী ব্যক্তিগণ খুব কঠিন সময়েও মাথা ঠান্ডা রাখতে জানেন, স্ট্রোকের ঝুঁকি থেকে বেঁচে যান এবং সর্বদা চিন্তা মুক্ত থাকতে জানেন। ইতিবাচক চিন্তা করার ক্ষমতা প্রকৃতিগতভাবে হয় না। এখন অনেক প্রকল্পের কার্যক্রমের মধ্যে ইতিবাচক মনমানসিকতার (Assertiveness Training ) উপর প্রশিক্ষণ প্রদান করে থাকেন। তবে আপনি অনুশীলনের মাধ্যমে ইতিবাচক চিন্তার অধিকারী হতে পারেন। বেশীর ভাগ মানুষ Knowledge Skill Approach (KSA) এর মধ্যে Knowledge ও Skill যথাযথ জ্ঞান ও দক্ষতা থাকলে ও Approach বা দৃষ্টিভঙ্গির কারনে পিছিয়ে পড়ে যায়। আসুন জেনে নেই কিভাবে ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ ঘটিয়ে নিজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করবেন তা সম্পর্কে।
কৃতজ্ঞ হওয়া
হান আল্লাহ খুব খুশী হয় তার বান্দা যখন কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আল্লাহতা’আলা বলেন- ‌‘যখন তোমাদের পালনকর্তা ঘোষণা করলেন যে, যদি কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো তবে তোমাদেরকে আরও দেব এবং যদি অকৃতজ্ঞ হও তবে নিশ্চয়ই আমার শাস্তি হবে কঠোর’। [সূরা ইব্রাহিম ১৪:৭] আল্লাহতা’আলার প্রতি আমাদের ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার প্রয়োজন নেই, পক্ষান্তরে তাঁর কৃতজ্ঞ হলে আমাদেরই কল্যাণ। আল্লাহতা’আলা বলেন, ‘আমি লোকমানকে প্রজ্ঞা দান করেছি এই মর্মে যে, আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞ হও। যে কৃতজ্ঞ হয়, সে তো কেবল স্বীয় কল্যাণের জন্যই কৃতজ্ঞ হয়। আর সে অকৃতজ্ঞ হলে তো আল্লাহ অভাবমুক্ত প্রশংসিত’ (সূরা লুক্বমান ৩১:১২)। আর হাদিসের আলোকে আবু সাঈদ খুদরি (রা.) হতে বর্ণিত আছে, মহানবী মুহাম্মদ (সা.) বলেছেন- ‘যে কেউ মানুষের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে না, সে আল্লাহরও কৃতজ্ঞ হয় না’ (তিরমিজি/১৯৫৫; আবুদাউদ/৪৮১১)। কৃতজ্ঞতা সুখী হতে, ইতিবাচক আবেগ তৈরিতে, সুস্থ-সুন্দর দেহ, সম্পর্কের উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করে। আপনি প্রতিদিন যে ভালো কাজগুলো করেন তার মধ্যে থেকে অন্তত তিনটি ভালো কাজ একটি ডায়েরিতে লিখে ফেলুন। প্রতিরাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে এর চর্চা করুন। একটি ডায়েরি ও কলম এনে দিনের তিনটি ভালো কাজ লিপিবদ্ধ করুন যার মাধ্যমে আপনি খুশি হয়েছেন। আপনি কেন কৃতজ্ঞ হয়েছেন তাও উল্লেখ করুন। প্রতি সপ্তাহের শেষের দিন ডায়েরি খুলে ভালো কাজগুলো পড়ুন। নিশ্চয়ই তখন আপনার খুব ভালো লাগবে। এভাবে প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহ এবং প্রতি মাসে চর্চা অব্যাহত রাখুন।
প্রার্থনা ও আত্মনিয়োগ
র্তমানে গুনাহ থেকে বেঁচে থাকা কঠিন থেকে কঠিন হয়ে পড়েছে। আমাদের উচিত প্রতিনিয়ত আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা। প্রতিদিন প্রার্থনার মাধ্যমে নিজের মানসিক ও ইতিবাচক শক্তি অর্জনের মাধ্যমে আত্মনিয়োগ করলে ইতিবাচক চিন্তার উন্নতি হয়। প্রতিনিয়ত প্রার্থনার মাধ্যমে জীবনের সমস্যা সমাধান করা যায় সহজেই। আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেন- তোমরা বিনীতভাবে ও গোপনে তোমাদের প্রতিপালকের কাছে দু’আ করবে (আল-আরাফ : ৫৫)। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেন- তোমরা যত প্রার্থনাই করবে আল্লাহ তার চেয়ে অনেক বেশি কবুল করতে পারেন (বুখারী- আল-আদাবুল মুফরাদ ও আহমদ)। এক গবেষণায় বলা হয়েছে, মনের শক্তির প্রয়োগ করে ডিএনএ পর্যায়ে গিয়ে ক্যান্সারের সহজ নিরাময় করা সম্ভব। তাই ইতিবাচক চিন্তা ভেতরে ও বাইরের জগতকে সাজিয়ে তোলে।
স্বেচ্ছাসেবী
স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করে অন্যকে সহযোগিতা করার মাধ্যমে আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি পায়, ইতিবাচক চিন্তার বিকাশ ঘটে, দুশ্চিন্তা দূর হয় এবং স্বাস্থ্য ভালো থাকে। চিন্তা করুন আপনার কোন দক্ষতা, গুণাগুণগুলোর মাধ্যমে অপরকে সহযোগিতা করতে পারবেন এবং কিভাবে, কত দ্রুত সহযোগিতা করতে পারবেন। অন্যকে সাহায্য করার মাধ্যমে আত্মতৃপ্তি অর্জন করা যায়। আপনি যদি ভালো বই পড়তে পছন্দ করেন তাহলে অন্যদের ভালো বই পড়ায় উৎসাহী করুন। আপনি যদি অন্য কোনো গুণাবলীর অধিকারী হয়ে থাকেন তাহলে তার বিকাশ ঘটান।
হাসুন মন খুলে
লা হয়ে থাকে হাসি হল সর্বোৎকৃষ্ট ঔষধ। শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে হলে প্রতিনিয়ত মন খুলে হাসুন। হাসলে শরীরে অসুখ বিসুখ দানা বাঁধতে পারে না এবং দুশ্চিন্তা আপনা আপনি বিদায় হয়। তবে অকারণে একা একা হাসলে লোকে আপনাকে বোকা ভাবতে পারে। তাই চমৎকার ও মজাদার কোনো সিনেমা দেখে হাসতে পারেন, বান্ধুবীর সাথে গল্প করতে করতে হাসতে পারেন, বাইরে বেড়াতে গিয়ে হাসতে পারেন, বন্ধুকে সাথে নিয়ে কেনা কাটা করতে গেলে হাসতে পারেন।
অন্যের প্রশংসা করা চাই
ন্যের গুণাগুণের প্রশংসা করুন বেশি করে। প্রশংসা করার মাধ্যমে উক্ত ব্যক্তির কাছে আপনি ভালো হৃদয়ের মানুষ বলে বিবেচিত হবেন। উক্ত ব্যক্তি আপনা্র প্রশংসাকে মর্যাদার সাথে গ্রহণ করবে। অনেকে মনে করেন অন্যের প্রশংসা করলে তিনি শীর্ষে উঠে যাবেন এবং প্রশংসাকারীকে মূল্যায়ন করবে না- এটা ভুল ধারণা। সর্বদা সুনির্দিষ্ট ভাবে উল্লেখ করে দিন আপনি কী কারণে তার প্রশংসা করছেন। যাকে প্রশংসা করবেন তাকে প্রকৃতভাবেই প্রশংসা করুন, মিথ্যা প্রশংসা নয়।
ইতিবাচক মানুষদের সাথে সখ্যতা
তিবাচক মনোভাবের উন্নতির জন্য আশেপাশে ইতিবাচক মানুষ থাকা প্রয়োজন। তাই ইতিবাচক চিন্তা করে, ইতিবাচক কাজ করে এমন মানুষের সাথে মিশুন। নেতিবাচক বাক্য বলা থেকে বিরত থাকুন। নেতিবাচকতা সম্পূর্ণভাবে পরিহার করুন। এভাবে জীবন সুন্দর ও সাফল্যময় হবে।
শরীরচর্চা
জীবনের সকল ভার, চাপ থেকে মুক্ত থাকার জন্য প্রয়োজন শরীরচর্চার অনুশীলন। প্রতিদিন শরীরচর্চা করলে শারীরিক ও মানসিকভাবে আপনি সুস্থ থাকবেন। প্রতিদিন শরীরচর্চা আপনার ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখবে, হার্ট সুস্থ রাখবে, আত্মবিশ্বাস বৃদ্ধি করবে। গবেষকগণ বলেন- আশাবাদী ও স্বপ্নবাজ মানুষেরা নিয়মিত ব্যায়ামে আগ্রহী থাকে কিন্তু হতাশাবাদীরা ব্যায়ামে আগ্রহী থাকে না।
পর্যাপ্ত ঘুম
প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম আপনাকে আশাবাদী করে তুলতে সহায়তা করবে। প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রতিদিন ৭-৯ ঘন্টা ঘুমানো উচিত। অনেকের সময়মতো ঘুম আসে না। তাই ঘুমের জন্য বা বিশ্রামের জন্য নরম সুরের গান ছেড়ে চোখ বন্ধ করে খানিক সময় বিশ্রাম নিতে পারেন। ঘুমাতে যাওয়ার আগে ভালো করে গোসল করলে তাড়াতাড়ি চোখে ঘুম চলে আসবে। অনেকের ঘুমের আগে বই পড়ার অভ্যাস। বই পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে যাওয়া দারুণ এক অভ্যাস। মানুষ যখন কম ঘুমায় তখন সে উদ্বিগ্ন থাকে এবং হতাশ থাকে। তাই আশাবাদী ও ইতিবাচক মনোভাবের বিকাশের জন্য ঘুমানো খুব প্রয়োজন।
অ্যালকোহল পরিহার
মানুষ যখন নেতিবাচক চিন্তা, নেতিবাচক পরিবেশ দ্বারা বেষ্টিত থাকে তখন অ্যালকোহল, ড্রাগসের দিকে ধাবিত হয়। অ্যালকোহল এবং ড্রাগে আসক্ত হলে নিজের মারাত্মক ক্ষতি করার ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই নেতিবাচকতা পরিহার করে ইতিবাচক থাকার জন্য অ্যালকোহল ও ড্রাগ পরিহার করুন।
অন্যের সাথে তুলনা নয়
ন্যের রূপ, গুণ ও সৌন্দর্যের সাথে কখনো নিজের রূপ, গুণ ও সৌন্দর্যের তুলনা করবেন না। কখনো অন্যের চেয়ে নিজেকে ছোট মনে করবেন না। অন্যের সাথে নিজের তুলনা করলে নিজের ওপর বিশ্বাস হারিয়ে যাবে এবং হতাশা আপনার পিছু ছাড়বে না।
ধৈর্য্য ধরে এত বড় লেখা পড়ার জন্য ধন্যবাদ ।

লেখক : উন্নয়ন সংগঠক, নির্বাহী পরিচালক- উন্নয়ন সংস্থা মাইশা