‘বীরত্বসূচক পদক’ বাতিল করা যায় না : শহীদুল্লাহ ফরায়জী

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
সম্প্রতি সাবেক রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ‘বীর উত্তম’ খেতাব বাতিলের বিষয়ে নিজের শক্ত অভিমত ব্যক্ত করে নিবন্ধ লিখেছেন খ্যাতনামা গীতিকার শহীদুল্লাহ ফারায়জী।  ১২ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত তাঁর নিবন্ধটি হুবহু তুলে ধরা হলো দৈনিক চট্টগ্রাম এর পাঠকের জন্য:
স্বাধীনতা অর্জনে প্রদত্ত বীরত্বপূর্ণ অবদানের খেতাব বা বীরত্বসূচক পদক বাতিল করা যায় না।  কারণ, বীরত্বপূর্ণ অবদান বা বীরত্ব প্রদর্শনের কারণে রাষ্ট্র নির্মিত হয়েছে।  সুতরাং এ রাষ্ট্রে তাঁর বীরত্বপূর্ণ অবদান বাতিল করার আইনগত ও নৈতিক কোনো সুযোগ নেই।  এই বীরত্ব সংরক্ষণ করা রাষ্ট্রের ‘অনিবার্য বাধ্যবাধকতা’।  এটা অপরিহার্যভাবেই জাতিরাষ্ট্রের অস্তিত্বের সাথে জড়িত।
সেক্টর কমান্ডার এবং জেড ফোর্সের অধিনায়ক জিয়াউর রহমান এর ‘বীর উত্তম’ খেতাব বাতিল করার প্রশ্ন এনেছে জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল।
বীরত্বসূচক খেতাব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে অসম সাহসিকতা প্রদর্শন এবং আত্মত্যাগের স্বীকৃতিস্বরূপ বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদেরকে প্রদত্ত খেতাব।  ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তি বাহিনীর সদস্যদের বীরত্ব ও সাহসিকতার কাজের স্বীকৃতি প্রদানের লক্ষ্যে বীরত্বসূচক খেতাব প্রদানের একটি প্রস্তাব মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি এমএজি ওসমানী মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিপরিষদে উপস্থাপন করেন।
পরবর্তীতে মন্ত্রিপরিষদের বৈঠকে বীরত্বসূচক খেতাব এর প্রস্তাব অনুমোদিত হয়।  অতঃপর স্বাধীনতা যুদ্ধে যারা অবদান রেখেছিলেন তাদের মধ্য থেকে সরকার বিভিন্ন জনকে তাদের অবদানের ভিত্তিতে বীরত্বপূর্ণ ‘বীরশ্রেষ্ঠ’ ‘বীর উত্তম’ ‘বীর বিক্রম’ ও ‘বীর প্রতীক’ খেতাব প্রদান করে।
যে রাষ্ট্রে যাদের খেতাব বাতিল করার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, সেই রাষ্ট্র নির্মাণে তাঁরা জীবনকে তুচ্ছ করে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।  সমগ্র মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে তাঁরা ব্যক্তি জীবনের সকল চাওয়া পাওয়াকে উপেক্ষা করে সমস্যাসঙ্কুল অভিযাত্রাকে সঙ্গী করে এবং মৃত্যু পরোয়ানাকে অবজ্ঞা করে সশস্ত্র যুদ্ধে সম্মুখ সমরে অংশগ্রহণ করে দেশকে হানাদার মুক্ত করার সর্বস্ব পণ করেছিলেন।
সেই দেশে স্বাধীনতার ৫০ বছর পরে অকৃজ্ঞতার সাথে কয়েক মিনিটের আলোচনায় তাদের বীরত্বপূর্ণ অবদান অস্বীকার করে বাতিল করে দেয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করে’।
তিনি বলেন, জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল এর ৭২ তম সভায় বীর মুক্তিযোদ্ধাদের খেতাব বাতিল করার কোনো এজেন্ডা ছিল না।  একজন সেক্টর কমান্ডার, সেনাবাহিনীর প্রধান এবং মেজর জেনারেল এর বীরত্বসূচক খেতাব “বীর উত্তম” বাতিল প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে এজেন্ডা বহির্ভূত আলোচনায়।  এই বুঝি বীর মুক্তিযোদ্ধা তথা মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা এবং সম্মান প্রদর্শনের মহড়া!  এই সব সিদ্ধান্ত মুক্তিযুদ্ধকে বিতর্কিত করার ইন্ধন জোগাবে এবং দেশকে অস্থিতিশীল করার উৎস হয়ে থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য যাঁদের খেতাব দেয়া হয়েছে তাঁদের এই খেতাব নির্ধারণ করেছিলেন বীর উত্তম এ কে খন্দকার এর নেতৃত্বে একটি কমিটি।  সর্বজনগ্রাহ্য মতৈক্যের ভিত্তিতে এসব খেতাব চূড়ান্ত করা হয়।  বঙ্গবন্ধু এই আদেশে স্বাক্ষর করেছিলেন প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকা মন্ত্রী হিসেবে।  আর এই খেতাব প্রদানের ঘোষণা প্রকাশিত হয়েছিল সামরিক গেজেটে।  রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে তখন তা কার্যকর করা হয়েছিল।
প্রসঙ্গত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের পর যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ পদক হিসেবে ‘বীর উত্তম’ খেতাব দেয়া হয়েছিল এবং এ তালিকায় তিন নম্বরে জিয়াউর রহমানের নাম লিপিবদ্ধ আছে।
প্রশ্নজাগে, যাদের বীরত্বসূচক খেতাব রাষ্ট্রপতির নির্বাহী আদেশে বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরে ‘সামরিক গেজেটে’ প্রকাশিত হয়েছিল, তাদের পদক জামুকা কীভাবে বাতিল করে।  কারণ, বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য রাষ্ট্র যাঁদেরকে খেতাব প্রদান করে তাঁদের উক্ত বিষয়ে জামুকার কোনো ধরনের সিদ্ধান্ত হবে বেআইনি এবং এখতিয়ার বহির্ভূত । ‘সামরিক গেজেট’ নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের এখতিয়ারও জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের নেই।
জিয়াউর রহমানের বীরত্বসূচক খেতাব বা সামরিক গেজেটে যাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত তাঁদের খেতাব বাতিল করতে হলে:
(১) স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁদের অসামান্য অবদান ও বীরত্ব প্রদর্শন অস্বীকার করে নতুন করে ‘সামরিক গেজেট’ প্রকাশ করতে হবে,
(২) প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট ‘সামরিক গেজেট’ সংশোধন করতে হবে।
লাখো লাখো শহীদের রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান, খ্যাতি ও মর্যাদা ক্ষুন্ন করার এই অবিবেচক চেষ্টা জাতির কাছে কোনোভাবেই গ্রহণীয় হবে না।
জাতীয় জীবনে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ সমুন্নত রাখা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সার্বিক কল্যাণ নিশ্চিতকরণের জন্য জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিলের আইনে বলা হয়েছে।  বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মান, মর্যাদা হানি বা পদক বাতিলের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল নয়।  মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য যাঁরা রাষ্ট্রীয় খেতাব পেয়েছেন এবং সামরিক গেজেটে যাঁদের নাম প্রকাশিত হয়েছে তাঁদের কর্মকান্ড যাচাই-বাছাইয়ের এখতিয়ার জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল এর নেই।
‘বীর উত্তম’ যোগ্যতায় বলা হয়েছে “বীরত্বসূচক অবদানের জন্য দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পুরস্কার”। আর পুরস্কৃত হওয়ার কারণে বলা হয়েছে “১৯৭১ এ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অসামান্য অবদান ও বীরত্ব প্রদর্শন”।
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মাননীয় মন্ত্রী বলেছেন, সম্মানসূচক পদবী বাতিল করার নজির কেবল বাংলাদেশে নয় বহির্বিশ্বেও আছে।
কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা পেয়েছেন ‘বীরত্বসূচক’ পদক। সম্মানসূচক পদক বাতিল করা হয় সম্মান রক্ষা করছেন না বলে, আর বীরত্বসূচক পদক তারাই অর্জন করেন যারা বীরত্ব প্রদর্শন করে ফেলেছেন, রাষ্ট্র গঠনে অসামান্য অবদান রেখেছেন।  ফলে ‘বীরত্বসূচক’ পদক বাতিল করার কোনো নৈতিক ভিত্তি নেই।
অতীতের বীরত্ব অতীতের অবদান বর্তমানের প্রেক্ষিতে বিচার করার কোনো আইনগত ও নৈতিক অধিকার কারো নেই।  প্রতিহিংসামূলক ও সংকীর্ণ কোনো রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ঐতিহাসিক ন্যায্যতাকে খারিজ করে দিতে পারে না।  এসব সিদ্ধান্ত ইতিহাসের সুবিচারকেও নিশ্চিত করে না।
স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের যে কোনো কর্মকাণ্ডের দায় আইনগতভাবে নিষ্পত্তি হবে।  শুধু বঙ্গবন্ধু নয় যেকোনো হত্যাকান্ডে যে কেউ জড়িত হলে তাকে আইনের আওতায় সোপর্দ করতে হবে।  প্রচলিত আইনে বিচার সম্পন্ন হবে, শাস্তি নির্ধারিত হবে।  রাষ্ট্রের কোনো নাগরিক আইনের ঊর্ধ্বে নয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময় মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক ভূমিকা ভবিষ্যতের ইতিহাস বিচার করবে জামুকা নয়।
যতদিন রাষ্ট্র থাকবে, রাজনীতি থাকবে ততদিন রাজনৈতিক দ্বিমত থাকবে, ভিন্নমত থাকবে।  থাকবে রাজনৈতিক বিরোধ।  কিন্তু বিরোধ হলেই যদি অবদান বা বীরত্ব বা সত্য অস্বীকার করা হয় তাহলে সত্য চিরকালের জন্য আত্মগোপন করবে।
প্রতিহিংসামূলক রাজনৈতিক সংস্কৃতি যদি এরূপভাবে অব্যাহত থাকে এবং এভাবে এক পক্ষ যদি অপর পক্ষের খেতাব কেড়ে নিতে থাকে তবে বীর মুক্তিযোদ্ধারা অচিরেই খেতাব হীন হয়ে পড়বেন এবং রক্তস্নাত গর্বের মুক্তিযুদ্ধ একটি বীরত্বহীন সাধারণ ঘটনায় পর্যবসিত হবে।
পৃথিবীতে কেউ বিতর্কের বাইরে নয়।  আওয়ামী লীগের সাথে রাজনৈতিক বিরোধ থাকলে সে আর মুক্তিযোদ্ধা থাকতে পারে না।  তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই আওয়ামী লীগ তাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করে, তিরস্কারের বাণ নিক্ষেপ করে।  মৃত্যুর পরেও এথেকে কারও রেহাই মিলছে না।
সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য বঙ্গবন্ধু সরকার যাদেরকে রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদান করেছেন বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তারাই আওয়ামী লীগ দ্বারা পাকিস্তানের চর ও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চক্রান্তকারী, ইত্যাদি অভিধায় অভিযুক্ত হয়েছেন।
এতে যে বঙ্গবন্ধুর আদেশ এবং বিবেচনাবোধ প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে এটাও অনেকের বিবেচনায় প্রাধান্য পাচ্ছে না।  মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় রাষ্ট্র পরিচালিত হচ্ছে না এটা এখন আর কোনো বলার বিষয় নয়।।  মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে আমরা কবেই নির্বাসন দিয়ে দিয়েছি।  এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।
জামুকার এই সিদ্ধান্ত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জ্বল কীর্তির প্রতি চূড়ান্ত অবমাননা।  স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর শুভলগ্নে এরূপ সিদ্ধান্ত হবে চরম আত্মঘাতী।
সরকার বা আওয়ামী লীগকে এই আত্মবিধ্বংসী রাজনীতি থেকে অবশ্যই বেরিয়ে আসতে হবে।

লেখক: গীতিকার
১২.০২.২০২১

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ