লামায় ১২৭ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ১১৭ টিতেই নেই শহীদ মিনার

বান্দরবান প্রতিনিধি, দৈনিক চট্টগ্রাম >>>
মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের এবার নিয়ে ৭৩তম বর্ষ পালন করতে যাচ্ছে বাঙালিজাতিসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। বছর ঘুরে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস এলে দেশের সব শ্রেণি পেশার মানুষ দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে ভাষা শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে ২১ ফেব্রুয়ারিতে প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু যাঁদের তাজা রক্ত আর আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে বাংলা ভাষা, তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা জানাতে বান্দরবান জেলার লামা উপজেলায় গুঁটিকয়েক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার থাকলেও নেই বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠানে।
বিদ্যালয়গুলোতে শহীদ মিনার না থাকায় শিক্ষার্থীরা তথা শিশুরা মাতৃভাষার যে ইতিহাস তা জানার সুযোগ পাচ্ছে না। শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে শহীদদের যথাযথ স্মরণ করতে পারে না। তবে কিছু কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোনোটিতে কলাগাছ বা কাঠ দিয়ে অস্থায়ীভাবে শহীদ মিনার বানিয়ে দিবসটি পালন করলেও কোনো কোনো প্রতিষ্ঠানে পালনই করা হয় না দিনটি। আবার কোথাও কোথাও শুধু মিলাদ ও দোয়া মাহ্ফিলের মধ্য দিয়ে শহীদদের স্মরণ করলেও অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানে সেটিও করা হয় না। কোনো কোনো শিক্ষার্থী দূর-দূরান্ত কিংবা উপজেলা শহরের শহীদ মিনারে গিয়ে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানালেও তা হয়ে ওঠে না অনেকেরই। ফলে ভাষার জন্য লড়াইয়ের পটভূমি ও ভাষা দিবসের মর্যাদা সম্পর্কে জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হওয়ার পাশাপাশি প্রতি বছর শহীদদের প্রতি ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানোর ইচ্ছে ম্লান হয়ে থাকে শিক্ষার্থীদের।
জানা যায়, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর আজ পর্যন্ত উপজেলার ১২৭টির মধ্যে ১১৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এখনো শহীদ মিনার স্থাপন করা হয়নি। এ কারণে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা দেশ মাতৃকার টানে ভাষা দিবসে সকল বীর সেনানীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদনের যথাযথ সুযোগ পাচ্ছে না।
বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণের দাবি তুলেছেন শিক্ষক, জনপ্রতিনিধি, মুক্তিযোদ্ধাসহ স্থানীয়রা।
এদিকে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শহীদ মিনার থাকলে নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা সহজে ভাষা আন্দোলনের গুরুত্ব সম্পর্কে ধারণা পেত বলে মনে করছেন সচেতন মহল।
উপজেলা প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর সূত্র জানায়, উপজেলার ৭টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা এলাকায় ৩টি কলেজ, সরকারি প্রাথমিক ৮৫টি ও ৪টি রেজিস্টার্ড প্রাথমিক বিদ্যালয় এবং ৫ কিন্ডার গার্টেন, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয় আছে ১৪টি। এছাড়া বেসরকারি বিদ্যালয় ও মাদ্রাসাসহ মিলিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে অন্তত ১৯টি। এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অন্তত ১৩ হাজার শিক্ষার্থী অধ্যয়নরত। অপরদিকে আড়াই লাখের কাছাকাছি জনগণের বসবাস। তথ্য প্রযুক্তির অপার সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে সারাদেশের মতো এ উপজেলাও এখন প্রযুক্তিখাতে অনেকাংশে এগিয়ে গেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন হয়েছে গত দুই দশকে। শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নতি সাধন হয়েছে আগের চেয়ে অনেকগুণ। শুধুমাত্র পিছিয়ে রয়েছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার স্থাপনের ক্ষেত্রে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লামা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি, সরকারি মাতামুহুরী কলেজে একটি, কোয়ান্টাম কসমো স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি, চাম্বি স্কুল অ্যান্ড কলেজে একটি, ডলুছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি, লামামুখ উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি, গজালিয়া উচ্চ বিদ্যালয়, মেরাখোলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি করে, ৩নং রিপুজিপাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে একটি, ফাইতং উচ্চ বিদ্যালয়ে একটি শহীদ মিনার রয়েছে। বাকি বিদ্যালয়গুলোতে এখনো নির্মাণ করা হয়নি শহীদ মিনার। ফলে ওইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর ভাষা দিবসের মত গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠান পালনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে উপজেলা সদরের বা ইউনিয়ন সদরে শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে এসে দূর্গম এলাকার শিক্ষার্থীরা দুর্ভোগের শিকার হচ্ছেন। কোনো কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার না বানিয়ে শুধু আলোচনা সভা, মিলাদ মাহ্ফিল ও প্রভাতফেরী করেই দিবসটি পালন করা হয়।
স্থায়ীভাবে কোনো শহীদ মিনার না থাকায় প্রতি বছর ভাষা দিবসে অস্থায়ীভাবে বাঁশ কাঠ দিয়ে নিজেরা শহীদ মিনার তৈরি করে বিভিন্ন বিদ্যালয়গুলোতে শহীদদের শ্রদ্ধা জানানো হয় বলে জানান রূপসীপাড়া ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছাচিংপ্রু মার্মা। তিনি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নির্মাণের জোর দাবি জানান।
সরেজমিনে নুনারবিল মডেল, রাজবাড়ী, লামামুখ, ছাগলখাইয়া, লাইনঝিরি, কলিঙ্গাবিল পাড়া ও সাবেক বিলছড়ি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে শহীদ মিনার নেই। এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জানান, তাদের বিদ্যালয়ে শহীদ মিনার না থাকায় তারা কখনো শহীদ মিনারে ফুল দেয়নি। ফুল দিতে গেলে অনেক দূরে যেতে হয়। তাই তারা যায় না।
প্রধান শিক্ষক জাহেদ সরোয়ার বলেন, সরকারিভাবে কোনো বরাদ্দ না থাকায় শহীদ মিনার নির্মাণ করা যায়নি। তাই একুশে ফেব্রুয়ারি এলে লামা সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শহীদ মিনারেই শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হয়। তবে এবছর থেকে উপজেলা পরিষদ চত্বরে নব নির্মিত শহীদ মিনারে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো যাবে।
১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সঠিক ইতিহাস সম্পর্কে ধারণা দিতে আর শহীদদের চেতনা পরবর্তী প্রজন্মের কাছে জিইয়ে রাখতে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার প্রয়োজন মনে করেন প্রধান শিক্ষক আশীষ কুমার দত্ত।
উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার শেখ মাহাবুবুর রহমান জানান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শহীদ মিনার না থাকার ব্যাপারটি জাতির জন্য বড় দুর্ভাগ্যের। শহীদ মিনার নির্মাণের ব্যাপারে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপির সাথে আলাপ করে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে।
এ বিষয়ে লামা উপজেলা ভারপ্রাপ্ত প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা আব্দুল করিম বলেন, প্রজন্মের কাছে মাতৃভাষার অর্জন-ইতিহাস উপস্থাপন করার জন্য অবশ্যই শহীদ মিনার জরুরি। কিন্তু উপজেলায় ৮৫টি বিদ্যালয়ের মধ্যে মাত্র ৩ টিতে শহীদ মিনার রয়েছে। বাকীগুলোতে শহীদ মিনার নেই। সেক্ষেত্রে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য সরকারিভাবে কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায় না। তবে যেসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শহীদ মিনার নেই সেসব প্রতিষ্ঠানে স্থানীয় প্রশাসন, ইউনিয়ন পরিষদ, পৌরসভা, পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী বীর বাহাদুরসহ বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সহযোগিতা নিয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নিতে শিক্ষকদের মিটিং এ বলা হয়েছে।

ডিসি/এসআইকে/এসপিআর