লামায় মুরগির খামারের বিষ্ঠার দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী নামলেন আন্দোলনে

মিজানুর রাহমান, লামা (বান্দরবান) থেকে >>>
পার্বত্য জেলা বান্দরবানের লামা উপজেলার গজালিয়া ব্রিকফিল্ড এলাকায় আবুহেনা মোস্তফাট মুরগি খামারের বিষ্ঠার দুর্গন্ধে অতিষ্ঠ এলাকাবাস।  খামারের বর্জ্যে দূষিত হচ্ছে পরিবেশ।  তীব্র দুর্গন্ধে গ্রামের বাসিন্দাদের চরম দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।  এ বিষয়ে প্রশাসনিক উর্দ্ধতন কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যানের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়েছে গ্রামবাসী।  পরে এর কোনো সুরাহা না পেয়ে পাহাড়ি-বাঙালি নিরুপায় হয়ে গতকাল রবিবার (১৪ জুন) বিকেল ৫ টার দিকে দূষণমুক্ত পরিবেশ চেয়ে সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনে নেমে পড়েন।
প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতি সামাল দিতে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন লামা থানা পুলিশের একটি বিশেষ টিম।  তবে গ্রামবাসী ক্ষিপ্ত হওয়ায় অসামাল হয়ে পড়ে তাদের জোরালো আন্দোলন।  খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন লামা উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুবাল চাকমা ও ইউপি চেয়ারম্যান বাবু বাথোয়াইসিং মার্মা।
এই ঘটনায় উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সুবাল চাকমা আন্দোলনরত গ্রামবাসীকে সান্ত্বনা দিয়ে উভয় পক্ষের শুনানি শেষে মুরগির খামারের মালিককে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে খামার সরিয়ে বা যে কোনো উপায়ে গ্রামবাসীকে দূষণমুক্ত পরিবেশ উপহার দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দেন।  অন্যথায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, লামা উপজেলার গজালিয়া ব্রিকফিল্ড এলাকায় মো. মঞ্জুরের ছেলে আবুহেনা মোস্তফা রিপন গ্রামের ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় ব্রয়লার মুরগির খামার স্থাপন করে ব্যবসা করছেন।  খামারের মুরগির বিষ্ঠার কারণে এলাকার পরিবেশ দূষিত হচ্ছে।  বিষ্ঠার দুর্গন্ধে খামারের চারদিকে মানুষের বসবাস করা দায় হয়ে পড়েছে।  অথচ নীতিমালা অনুযায়ী, একটি মুরগির খামার স্থাপনের জন্য পরিবেশ অধিদপ্তরের অনুমতি ও প্রাণিসম্পদ কার্যালয় থেকে রেজিস্ট্রেশনভুক্ত হতে হয়।  ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা এবং জনগণের ক্ষতি হয় এমন স্থানে খামার স্থাপন করা দণ্ডনীয় অপরাধ।  তা সত্ত্বেও ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় এদের ব্যবসা জমজমাট হচ্ছে কোন যুক্তিতে বা কার ইন্ধনে- জানতে চায় আন্দোলনকারী গ্রামবাসী।
জানা গেছে, পরিবেশ দূষিত মুরগির খামারের বিষয়ে গত এক মাস আগে প্রশাসন ও ইউপি চেয়ারম্যানকে অভিযোগ করা হয়।  পরে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট অভিযান চালিয়ে খামারের মালিক পক্ষকে ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করা হলেও খামারের বর্জ্য অপসারণের ক্ষেত্রে খামার কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।  মুরগির বিষ্ঠার তীব্র দুর্গন্ধে গ্রামের পথঘাটে হাঁটা যায় না।  এমনকি বসতঘরের মধ্যেও থাকা যাচ্ছে না বলে অভিযোগ স্থানীয়দের।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, মুরগির খামারের বিষ্ঠা ও ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কার করা পানি ও বর্জ্য সরাসরি এলাকার ছোট্ট নদীতে নির্গত হচ্ছে নালার মাধ্যমে।  ফাতেমা পারুল নামে স্থানীয় এক নারী দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, আমাদের এলাকায় এই ছোট্ট নদী ছাড়া অন্য কোনো পানির উৎস নেই।  এই নদীর পানিগুলো অজু, গোসল, কাপড়-চোপড় ধোয়াকাচাসহ সব কাজে ব্যবহার করা হয়।  কিন্তু খামারের বিষ্ঠা ও ময়লা-আবর্জনায় নদীর পানি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
স্থানীয় মার্গারুর ত্রিপুরা বলেন, রাতের আঁধারে গ্রামের পতিত জমিতে বা রাস্তার পাশে মরা মুরগিসহ বিষ্ঠাভর্তি বস্তার স্তূপ করে রেখে যায় তারা।  দুর্গন্ধে মানুষ যাতায়াত করতে পারে না।  নদী ও পতিত জমিতে পড়ে থাকা মরা মুরগিগুলো কুকুর, শেয়াল ও কাক খেয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রাখে।  এসব কারণে মানুষ ও গৃহপালিত পশু-পাখির মধ্যে দেখা দিয়েছে ডায়রিয়াসহ নানাবিধ রোগবালাই।  তিনি আরো বলেন, করোনা ভাইরাস কি বুঝিনা।  তবে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় করোনা হচ্ছে এই খামারের দুর্গন্ধ।  বাড়ির সবাইকে নিয়ে ভাত খেতে গেলে মনে হয় মুরগির পায়খানা রান্না করে খাচ্ছি।  গর্ভবতী, বয়স্ক, এমনকি ছোট থেকে বড় পর্যন্ত সবাই এই দূষিত পরিবেশের শিকার।  আমরা এর নিরসন চাই।  এই নিয়ে এলাকাবাসী মালিকপক্ষকে অভিযোগ করলে এমন পরিবেশ অসহনীয় হলে গ্রাম ছেড়ে অন্য কোথাও চলে যাওয়ার জন্য বলে দেন।
তবে এসব অভিযোগ মিথ্যা দাবি করেছেন মালিকপক্ষ।  তবে মালিকপক্ষ এক সপ্তাহের জন্য সময় চাইলে সময় না দিতে অসম্মতি প্রকাশ করেন গ্রামবাসী।  কারণ এরকম অনেক বার সময় চেয়ে সেই কথা রাখেনি মালিকপক্ষ- এমন দাবি করেন গ্রামবাসী।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, মুরগির খামারের বর্জ্যের কণা শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে মানুষের শরীরে ঢুকে অ্যালার্জি, চর্ম, শ্বাসকষ্টসহ ফুসফুসের রোগ হওয়ার আশঙ্কা সৃষ্টি করে।  এর থেকে শ্বাসকষ্ট এবং হার্টের ক্ষতি হওয়ারও সম্ভাবনাও রয়েছে।  এসব খামার সংলগ্ন এলাকার মানুষ বেশিরভাগ স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে থাকে।
ইউপি চেয়ারম্যান বাথোয়াইসিং মারমা দৈনিক চট্টগ্রামকে বলেন, মুরগির খামার কর্তৃপক্ষকে সরাসরি, সামাজিক মিটিং ও নোটিশের মাধ্যমে অনেকবার সতর্ক করা হয়েছে।  কিন্তু তারা কোনো কর্ণপাত করেনি।  ওরা ব্যবসা করুক।  এরকম ছোটখাটো শিল্প গড়ে উঠুক আমরা চাই।  তবে পরিবেশ অধিদপ্তরের নীতিমালা মেনে আশেপাশে বসবাসরত মানুষের সুবিধা-অসুবিধা বিবেচনা করা তো প্রয়োজন।  তিনি আরো বলেন, আমার লিখিত কোনো কাগজের দরকার নাই।  তবে আগামিকাল থেকে পরিষ্কার করে দিবেন।  এতে আন্দোলনকারীরা শান্ত থাকবে।  অন্যথায় কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে এর দায়ভার মুরগির খামার কর্তৃপক্ষকে নিতে হবে।

ডিসি/এসআইকে/এমআর