বস্তিতে করোনা আক্রান্তের হার কম কেন?

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
করোনা ভাইরাসে আক্রান্তের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।  বাড়ছে আক্রান্ত হয়ে মৃতের সংখ্যাও।  বিশেষজ্ঞরা বলেছিলেন, করোনায় রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশের বস্তিগুলোয় ও নিম্নআয়ের মানুষদের ক্ষতি হবে বেশি।  কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, বস্তি ও নিম্নআয়ের মানুষের মধ্যে করোনা আক্রান্তের সংখ্যা অনেক কম।  কারণ জানতে চাইলে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একটি কারণ হলো বস্তি ও নিম্ন আয়ের মানুষের মধ্যে করোনা আক্রান্তের সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই।  তবে এই সংখ্যা যে কম, তা সাদা চোখেও বোঝা যাচ্ছে।  তা না হলে মৃতের সংখ্যা আরও অনেক বেশি বেড়ে যেতো।  আরেকটি কারণ হতে পারে, বস্তিগুলোতে হয়তো অনেকেই নিজের অগোচরেই আক্রান্ত হয়ে আবার সুস্থ হয়ে উঠেছেন।  এছাড়া এসব মানুষ তুলনামূলক শারীরিক পরিশ্রম বেশি করেন।  একারণে তাদের শরীরে অ্যান্টিবডি তৈরি হয়ে যাচ্ছে।  শরীরে হয়তো ইমিউনিটির পরিমাণও বেশি।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও কোভিড-১৯ বিষয়ক কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বস্তিতে যদি করোনার প্রকোপ অন্যান্য জায়গার মতো হতো, তাহলে অনেক মানুষ মারা যেতো।  কারণ এমনিতেই বস্তিগুলো ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা।  হাত ধোয়ার মতো স্বাস্থ্যবিধি মানার প্রবণতাও কম’।  তবে এ সম্পর্কে গবেষণা করা দরকার মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এ সম্পর্কে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না, কেন এমন হচ্ছে।  গবেষণা করে কতজন পজিটিভ আর নেগেটিভ, সেটা বের করে দেখা যেতে পারে।  কেন এমন হলো সেটাও গবেষণা করা জরুরি’।
করোনার উপসর্গ নিয়ে যারা মারা যাচ্ছেন তাদের মধ্যে বস্তি এলাকার মানুষের হার কতো সেটা দেখতে হবে মন্তব্য করে শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ভাইরোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘বস্তির মানুষ আক্রান্ত হচ্ছেন, কিন্তু হয়তো শনাক্ত হচ্ছেন না।  করোনাতে যারা আক্রান্ত হন তাদের মধ্যে শতকরা ৮০ শতাংশেরই লক্ষণ বা উপসর্গ থাকে না।  আবার যারা কর্মঠ তারা হালকা সর্দি কাশি হলে বলেনও না।  সচেতনতার অভাবে সেটা আমলে নেন না।  সবকিছু মিলিয়ে কম বলা যাবে না।  হয়তো আমরা খবর পাচ্ছি কম।  আক্রান্ত কম এটা বলতে আমাদের স্টাডি করা লাগবে।  কিন্তু এ ভাইরাসের যে চরিত্র তাতে করে বেশি হওয়া ছাড়া কম হওয়ার কোনও যুক্তি নাই’।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ২০১৪ সালে বস্তিশুমারি ও ভাসমান লোকগণনা জরিপ করেছিল।  সরকারি এই সংস্থার তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার উত্তর সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ১ হাজার ৬৩৯টি বস্তি রয়েছে।  এসব বস্তিতে খানা বা ঘর বা পরিবার রয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার ৩৪০টি।  আর খানাসদস্য ৪ লাখ ৯৯ হাজার ১৯ জন।  এছাড়া দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন এলাকায় বস্তি রয়েছে ১ হাজার ৭৫৫টি। এসব বস্তিতে খানা বা ঘর বা পরিবার রয়েছে ৪০ হাজার ৫৯১টি।  এসব ঘরে বসবাস করেন ১ লাখ ৪৭ হাজার ৫৬ জন।  তবে গত কয়েক বছরে এই সংখ্যা আরও অনেক বেড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বাস্থ্য অধিদফতরের তথ্য অনুযায়ী, রাজধানী ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় কত জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছে এর সুনির্দিষ্ট সংখ্যা থাকলেও কোন বস্তিতে কত জন আক্রান্ত তার কোনো তথ্য নেই।  স্বাস্থ্য অধিদফতর বলছে, ২৪ জুন পর্যন্ত রাজধানীর মহাখালী এলাকায় মোট ৫৬৬ জন করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন।  মহাখালীতেই বাংলাদেশের দুটি বড় বস্তি রয়েছে, যার একটি কড়াইল বস্তি ও অপরটি সাততলা বস্তি হিসেবে পরিচিত।
কড়াইল বস্তিতে বিবিএস-এর ২০১৪ সালের করা জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সেখানে ১০ হাজার ২২২টি ঘর বা খানা রয়েছে।  এসব খানায় ৩৬ হাজার ৭১৯ জন বাস করেন।  কিন্তু স্থানীয় বস্তি উন্নয়ন কমিটির নেতারা বলছেন, এই বস্তিতে ১২ হাজার ঘর রয়েছে।  বস্তির লোকসংখ্যা প্রায় আড়াই লাখের মতো।
কড়াইল বস্তি এলাকাটি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন।  এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মফিজুর রহমান বলেন, ‘কড়াইল বস্তিতে করোনা আক্রান্ত নেই বললেই চলে।  এখানে করোনায় আক্রান্ত হয়ে কেউ মারাও যায়নি।  যে দু-একজনের উপসর্গ দেখা গিয়েছিল তারা ভালো হয়ে গিয়েছে।  আমরা নিয়মিত বস্তির লোকজনের খোঁজ-খবর করছি’।
একই অবস্থা মহাখালীর সাততলা বস্তির ক্ষেত্রেও।  বিবিএস এর ২০১৪ সালের বস্তি শুমারির তথ্য বলছে, এই বস্তিতে ঘরসংখ্যা ৬ হাজার ৮৪৫টি। এসব ঘরে ৪ হাজার ৩৭৩টি পরিবারের বসবাস।  জনসংখ্যা ২১ হাজার ৮৬৯।  তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও অনেক বেশি।  এই বস্তিটি ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের ২০ নম্বর ওয়ার্ডের আওতাধীন।
এই ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মো. নাছির বলেন, ‘আল্লাহর ইচ্ছায় সাত তলা বস্তিতে কেউ করোনা আক্রান্ত হয়নি।  বস্তিতে লক্ষাধিক লোক বাস করে।  এখানে একটি ছোট্ট ঘরে ৪-৫ জন লোক একসঙ্গে ঘুমায়।  কিন্তু বস্তির কোনো লোক এখন পর্যন্ত করোনায় আক্রান্ত হয়েছে বলে আমার জানা নেই’।  তিনি বলেন, ‘সাত তলা বস্তির পাশে স্টাফ কোয়ার্টার আছে।  সেখানে হাসপাতালের নার্স বা স্টাফদের অনেকেই থাকেন।  সেখানে একসঙ্গে ৪-৫ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন।  কিন্তু বস্তিতে আমি নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখছি।  এখানে কেউ আক্রান্ত হন নাই বা করোনার উপসর্গ নিয়ে কেউ মারাও যাননি’।
বস্তি এলাকাতে করোনা আক্রান্ত রোগী কম কেন এমন প্রশ্নে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান (আইইডিসিআর) এর উপদেষ্টা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, ‘কম-বেশি সুনির্দিষ্ট করে বলা যাবে না।  তবে বস্তি এলাকার জনসংখ্যার ডেমোগ্রাফিক পিরামিড হচ্ছে সেখানে যুবক-তরুণদের সংখ্যা বেশি, বৃদ্ধরা গ্রামে থাকে।  যার কারণে তারা আক্রান্ত হলেও তা তুলনামূলকভাবে কম হচ্ছে।  তবে আক্রান্ত অবশ্যই হচ্ছে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘মৃদু লক্ষণে তারা গা করে না, পাত্তা দেয় না।  তবে ফ্যাটাল কেস না যেহেতু ঝুঁকিপূর্ণ বয়স এখানে কম।  আর বিশেষ করে এই করোনার সময় সবল, কাজ করতে পারে, বয়স কম তারাই ঢাকায় টিকে রয়েছে।  সিনিয়র পপুলেশন এখন ঢাকায় নেই, যার কারণে মৃত্যু সংখ্যা কম ওখানে’।
করোনা সম্পর্কে নিজের পর্যবেক্ষণের কথা জানিয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘যারা মাটির সঙ্গে সংযুক্ত থেকে খোলামেলা রোদে বা বাতাসে কাজ করেন, শারীরিক শ্রম বেশি দেন তাদের মধ্যে করোনা আক্রান্তের প্রকোপ কম।  এর নির্ণায়কগুলো হলো, শারীরিক শ্রম, রোদে কাজ করা, খোলা বাতাস এগুলো দিয়ে শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়।  একইসঙ্গে এরা ফ্রিজে রাখা বা সংরক্ষিত খাবার কম খান।  এই নির্ণায়কগুলো আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে দেয়।  দ্বিতীয়ত, যারা শীতাতপ জায়গায় বেশি থাকেন এবং যারা খোলা রোদে একেবারেই কম যান, খালি পায়ে কম হাঁটেন, সংরক্ষিত খাবার বেশি খান এবং কৃত্রিম আলোতে দিনের বেশিরভাগ সময় থাকেন, তাদের শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়।  ফলে তাদের কোভিড-১৯ বেশি আক্রমণ করছে।  এটা শুধু কোভিড-১৯ এর জন্য না, সমস্ত ভাইরাসের জন্যই প্রযোজ্য’। সূত্র- বাংলা ট্রিবিউন

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ