৭ জেলায় ১২ জনের মৃত্যু আম্ফানের তাণ্ডবে 

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
সুপার সাইক্লোন আম্ফানে লন্ডভন্ড হয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ।  সেই তাণ্ডবের তাপ লেগেছে বাংলাদেশেও।  তীব্র ঝড়ো বাতাস আর বৃষ্টি ঝড়িয়ে সাগর থেকে উপকূলে উঠেছে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান।  এর মূল চোখ ভারতের দিকে।  তবে বাংলাদেশের উপকূলীয় জেলা সাতক্ষীরা ও সুন্দরবন অংশের ওপর তোপ দাগার পর আম্ফানের বাংলাদেশ অংশটি উঠে গেছে স্থলভাগে।  এটি এখন উত্তরবঙ্গে।  অন্যদিকে, অন্য উপকূলীয় জেলাগুলোতে ঝড়ের তীব্রতা খুব বেশি না হলেও আজ বৃহস্পতিবার (২১ মে) সকাল পর্যন্ত ১২ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে যশোরে গাছ চাপা পড়ে মা-মেয়েসহ তিন নারী নিহত হয়েছেন।  পটুয়াখালীতে ঝড়ে গাছ চাপা পড়ে ও মানুষকে সচেতন করতে গিয়ে নৌকাডুবিতে দু’জন মারা গেছেন।  ভোলায় গাছচাপা পড়ে ও ট্রলারডুবে দুই জন মারা গেছেন।  পিরোজপুরের মঠবাড়িয়াতে দেয়াল চাপা পড়ে মারা গেছেন আরেক ব্যক্তি।  আর সাতক্ষীরা সদরে আম কুড়াতে গিয়ে গাছ চাপায় দুই জনের মৃত্যু হয়েছে।  চাঁদুপুরেও আম কুড়াতে গিয়ে একজন মারা গেছেন।
সাতক্ষীরার সাগরের নিকটবর্তী এলাকাগুলোতে বুধবার (২০ মে) সন্ধ্যায় ৫ থেকে ৭ ফুট জোয়ার হয়েছে।  ভারী বৃষ্টি হয়েছে প্রায় সারারাতই।  সাতক্ষীরা সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আসাদুজ্জামান জানান, ঝড়ের মধ্যে আম কুড়াতে গিয়ে সদরের শহরের বাঁকাল এলাকায় শামসুর রহমান (৬০) ও কামালনগর সঙ্গীতা মোড়ে করিমন নেছা (৪০) নামে দু’জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের আঘাতে সাতক্ষীরা শ্যামনগরের উপকূলীয় অঞ্চল, আশাশুনি ও সাতক্ষীরা সদরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।  কাঁচাঘর বাড়ি মৎস্যঘের ও ফসলি জমির ক্ষতি হয়েছে।  আশাশুনির ৬টি পয়েন্ট ও শ্যামনগরের একটি পয়েন্টে বেঁড়িবাধ ভেঙে বিস্তীর্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে।
গাবুরা এলাকার বাসিন্দা নজরুল মিয়া বলেন, আম্ফানে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে পুরো গাবুরা ইউনিয়ন।  আমার বাড়ির অধিকাংশ গাছ পড়ে গেছে।  এই ঝড়ে আমাদের কংক্রিটের প্রাচীর পর্যন্ত পড়ে গেছে।  সেই বিকাল থেকে ঝড় শুরু হয়েছে একটানা গভীর রাত পর্যন্ত চলেছে।
শ্যামনগরের হাসান আল জাকির নামে এক স্বেচ্ছাসেবক বুড়িগোয়ালীনির ইউনিয়নের দাতানিখালি এলাকায় বেড়িবাঁধে ভাঙনের বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
প্রতাপনগর ইউপি চেয়ারম্যান জাকির হোসেন বলেন, ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে নদীতে জোয়ার বৃদ্ধির কারণে প্রতাপনগরের কুড়ি কাউনিয়া, সুভদ্রা কাটি, চাকলা, হাজরাখালি পয়েন্টে বেঁড়ি বাঁধ ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে।  এদিকে আশাশুনি সদরের জেলেখালি পয়েন্টে ভেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে।
ভোলায় ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের প্রভাবে সৃষ্ট ঝড়ে গাছের নিচে চাপা পড়ে ছিদ্দিক ফকির (৭০) ও ট্রলারডুবিতে মো. রফিকুল ইসলাম নামের দুই জনের মৃত্যু হয়েছে।  নিহত ছিদ্দিক ফকির জেলার চরফ্যাশন উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার চর মানিকা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ও রফিকুল ইসলাম জেলার বোরহানউদ্দিন থানার মনিরাম এলাকার বাসিন্দা।  বুধবার (২০ মে) দুপুরে উপজেলার দক্ষিণ আইচা থানার প্রধান সড়কে ঝড়ে গাছের ডাল পড়ে ছিদ্দিক ফকিরের মৃত্যু হয়।  বিকালে সদর উপজেলার রাজাপুরের মেঘনা নদীতে ট্রলার ডুবিতে রফিকুল ইসলামের মৃত্যু হয়।
আম্ফানের প্রভাবে যশোরে প্রবল ঝড়ে জেলার বিভিন্ন এলাকায় গাছ-পালা উপড়ে পড়েছে।  চৌগাছা উপজেলার চানপুর গ্রামে ঘরের উপর গাছ পড়ে এক নারী ও তার মেয়ে নিহত হয়েছেন।  বুধবার রাত সাড়ে ১১ টার দিকে এ দুর্ঘটনা ঘটে।  নিহতরা হলেন চানপুর গ্রামের মৃত ওয়াজেদ হোসেনের স্ত্রী খ্যান্ত বেগম (৪৫) ও তার মেয়ে রাবেয়া (১৩)।  এছাড়া বাঘারপাড়া উপজেলার বুদোপুরে আমগাছ ভেঙে ঘরে পড়ে। এতে চাপা পড়ে মারা যান সাত্তার মোল্লার স্ত্রী ডলি বেগম (৪৮)।
যশোরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর আবহাওয়া দফতর জানিয়েছে, আম্ফানের কেন্দ্র রাত সাড়ে ১০টা থেকে যশোরের পশ্চিম দিয়ে অতিক্রম শুরু করে।  আম্ফানের প্রভাবে সন্ধ্যা ৭টা থেকে ঝড়ো হাওয়া শুরু হয়।  এরপর আস্তে আস্তে তা বাড়তে থাকে।  রাত ১২ টায় সর্বশেষ বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ১৩৫ কিলোমিটার।
চৌগাছা উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা জাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, রাত সাড়ে ১১ টার দিকে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে চৌগাছা উপজেলার চানপুর গ্রামে একটি ঘরের ওপর গাছ পড়ে খ্যান্ত বেগম ও তার মেয়ে রাবেয়া নিহত হন।  স্থানীয়দের মাধ্যমে তিনি এ তথ্য জানতে পেরেছেন।
অন্যদিকে, পটুয়াখালীতে গাছ চাপা পড়ে একজন এবং মানুষকে সতর্ক করতে গিয়ে নৌকা ডুবে উপজেলার প্রচারাভিযানে একটি ইউনিটের দলনেতা মারা গেছেন।  গলাচিপা থানার ওসি মো. মনিরুল ইসলাম নিশ্চিত করেছেন- সন্ধ্যায় গলাচিপা উপজেলার পানপট্টি এলাকায় ঝড়ে গাছের ডাল ভেঙে এর নিচে চাপা পড়ে রাসেদ নামে ৬ বছরের একটি শিশু। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়।
অন্যদিকে, কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) আবু হাসনাত মোহাম্মদ শহিদুল হক নিশ্চিত করেছেন, পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় জন সচেতনতার প্রচার কাজ চালাতে গিয়ে ধানখালীর ছৈলাবুনিয়া এলাকায় খালে নৌকা ডুবে সিপিপি’র দলনেতা শাহ আলম নিখোঁজ হন।  পরে ডুবুরি দল তার লাশ উদ্ধার করেছে।  তিনি জানান, জোয়ারের পানিতে তলিয়ে গেছে কলাপাড়া, গলাচিপা ও রাঙ্গাবালী উপজেলার অন্তত ১৭টি গ্রাম।
এদিকে, পটুয়াখালীতে আম্ফানের ক্ষয়-ক্ষতি মনিটরিং করার জন্য জেলা ও উপজেলায় ১০টি কন্ট্রোল রুম খোলা হয়েছে।  জেলায় মোট ৭৫২টি আশ্রয় কেন্দ্রে পর্যাপ্ত শুকনো খাবার পৌঁছে দেওয়া হয়েছে।  সিভিল সার্জনের পক্ষ থেকে ৩২৫টি মেডিকেল টিম কাজ করছে।  পায়রা বন্দরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সতর্কাবস্থানে রয়েছে।  বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে বন্দরের সব কার্যক্রম।
পটুয়াখালীতে আম্ফান মোকাবিলায় কাজ করছে জেলা ও উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি, কোস্টগার্ড, ফায়ার কর্মী, আনসার, স্বেচ্ছাসেবী সদস্যসহ সংশ্লিষ্টরা।
অন্যদিকে, পিরোজপুর জেলার মঠবাড়িয়া উপজেলা শহরের ৬ নম্বর ওয়ার্ডের ১ নম্বর সড়কে দেয়াল চাপা পড়ে এক ব্যক্তি মারা গেছেন।  তার নাম শাজাহান মোল্লা (৬০)।  রাত সাড়ে আটটায় এ দুর্ঘটনা ঘটে।  মঠবাড়িয়া থানার ওসি মাসুদুজ্জামান বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।  তার গ্রামের বাড়ি গিলাবাদ।
চট্টগ্রামে ঘূর্ণিঝড় আম্ফান আঘাত হানার আগেই জোয়ারের পানিতে ডুবে মো. সালাউদ্দিন (১৮) নামে এক তরুণের মৃত্যু হয়েছে।  বুধবার (২০ মে) দুপুরে চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলার পৌর সদরের ২ নম্বর ওয়ার্ডে এ ঘটনা ঘটে।  সন্দ্বীপ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা বিদর্শী সম্বৌধি চাকমা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।  উপকূলে ঘাস কাটতে গিয়ে সালাউদ্দিন জোয়ারের পানিতে পড়ে যান বলে তিনি জানান।
চাঁদপুরে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানে গাছ চাপা পড়ে জান্নাত বেগম (৩৫) নামে এক নারীর মৃত্যু হয়েছে।  তিনি চাঁদপুর সদর উপজেলার ৯ নম্বর বালিয়া ইউনিয়নের রাড়িরপুল এলাকার ওহাব গাজীর মেয়ে।  বুধবার রাতে এ ঘটনা ঘটে।  এছাড়া জেলায় আর তেমন কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।
স্থানীয়রা জানান, আম্ফানের প্রভাবে ঝড়ো বাতাস চলাকালীন রাত ২ টার দিকে জান্নাত বেগম আম খুঁজতে গেলে গাছের ডাল ভেঙে মাথায় পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই তিনি মারা যান।
বাগেরহাট পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৩৫/১ পোল্ডারের শরণখোলা উপজেলার সাউথখালী ইউনিয়নের বগী এলাকার বেরিবাঁধ ভেঙে কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত ছাড়া আর কোনো ক্ষয়ক্ষতির খবর পাওয়া যায়নি।  জেলা সদরসহ সবক’টি উপজেলা বিদ্যুৎবিচ্ছিন্ন রয়েছে।  জোয়ার ও বৃষ্টির পানিতে জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত হয়েছে বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন।
ঘূর্ণিঝড় আম্ফান থেকে রক্ষা পেতে উপকূলীয় জেলা বাগেরহাটের প্রায় ২ লাখ ৬৮ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে।  এছাড়া প্রায় ২৩ হাজার গবাদি পশু নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে।  বাগেরহাটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ( সার্বিক) মো. কামরুল ইসলাম এই তথ্য জানান।
পঞ্চগড় প্রতিনিধি জানান, শুধু উপকূল নয়, দেশের উত্তরপ্রান্তের জেলা পঞ্চগড়েও আম্ফানের প্রভাবে রাতে ঝড়ো হাওয়াসহ বৃষ্টি হয়েছে।  সারাদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকলেও রাত ১০টা থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে।  রাতে একাধিকবার বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে গেছে।  মাঝে মাঝে দমকা হাওয়া বইছে।
বাংলাদেশ আবহাওয়া পূর্বাভাস কেন্দ্রের বরাত দিয়ে পঞ্চগড়ের তেতুঁলিয়া প্রথম শ্রেণি আবহাওয়া পর্যবেক্ষণাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা রহিদুল ইসলাম জানান, বৃহস্পতিবার, শুক্রবার এবং শনিবারও হাল্কাসহ ভারীবর্ষণ হতে পারে।  এটা রবিবার পর্যন্তও স্থায়ী হতে পারে।
পঞ্চগড়ে ছিল দিনভর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি। পঞ্চগড় জেলা পরিবেশ পরিষদের সভাপতি ও পঞ্চগড় সরকারি মহিলা কলেজের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের বিভাগীয় প্রধান তৌহিদুল বারী বাবু জানান, হিমালয়ের কাছাকাছি পঞ্চগড়ের অবস্থান।  এজন্যই পঞ্চগড়ে আম্ফানের কিছুটা প্রভাব পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে।  হিমালয়ে বাধাপ্রাপ্ত হয়ে ফিরে যাওয়ার সময় পঞ্চগড়ে ভারীবর্ষণ হতে পারে।  এ সময় পঞ্চগড়ের কৃষকদের বোরো ক্ষেত ও ভুট্টাসহ বেশ কিছু ফল ও ফসলের ক্ষতি হতে পারে।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন জানান, জেলার পাঁচ উপজেলার কৃষি বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে সতর্ক থাকার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।  ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের ফলে কোথাও ক্ষয়ক্ষতি হলে তা তাৎক্ষণিক জানানো এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ