উত্তর কাট্টলীতে পরিবর্তনে সোচ্ছার অন্য প্রার্থীরা, সুযোগ পেলে প্রত্যাশা পূরণের অঙ্গীকার মঞ্জুর

ডান থেকে নিছার উদ্দিন আহমেদ, সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী, মনোয়ারুল আলম নোবেল, রফিক আহমেদ, আব্বাস রশিদ, গিয়াস উদ্দিন জুয়েল, শাহেদ আকবর।

রুম্পা বিশ্বাস, নিজস্ব প্রতিবেদক >>>
চট্টগ্রামের গুরুত্বপূর্ণ ওয়ার্ড চসিকের উত্তর কাট্টলী। ৪ বর্গকিলোমিটার আয়তনের এ ওয়ার্ডে১ লাখ ৩৫ হাজার মানুষের বসবাস। বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যখন কোনো আন্দোলন-সংগ্রামের ডাক দেয় তখন প্রথমেই পরিকল্পনা করে নগরীকে অবরুদ্ধ করার। আর সেই স্থানটি বেছে নেয়া হয় এই ওয়ার্ডে অবস্থিত সিটি গেইট এলাকাকে। নানান কারণে দেশজুড়ে আলোচিত এই ঐতিহ্যবাহি ওয়ার্ডটি শিক্ষা, সংস্কৃতি ও রাজনীতির তীর্থস্থান বলেখ্যাত। এই ওয়ার্ডে যেমন দেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের শীর্ষ নেতারা জন্মগ্রহণ করেছেন, তেমনি প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ নানান পদে নেতৃত্বও দিচ্ছেন এই ওয়ার্ডের অধিবাসীরা। চট্টগ্রাম- ৪সংসদীয় আসনে নগরের যে দু’টি ওয়ার্ড সংযুক্ত এর একটি ১০ নম্বর উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ড। এই আসনের সংসদ সদস্যের আবাসস্থলও এই ওয়ার্ডে।সাবেক মন্ত্রী মরহুম নূরুল হক চৌধুরী, জহুর আহমদ চৌধুরী, সাবেক প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ও মন্ত্রী মাহমুদুন্নবী চৌধুরী, আলিমুল্লাহ চৌধুরী, গবেষক মওলানা তমিজুর রহমান চৌধুরী, শিক্ষক মোহাম্মদ জামান হেডমাস্টার, ভাষা সৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী, সাবেক মন্ত্রী আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী যেমন এই এলাকার সন্তান, তেমনি সাবেক মেয়র এম মনজুর আলম, ডেপুটি মেয়র এম আবু নাছের চৌধুরী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. অধ্যাপক ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীসহ দেশের অন্যতম বৃহত ব্যবসায়ী গ্রুপের কর্ণধার, সরকারের সচিব, যুগ্মসচিব, জনপ্রিয় অভিনেত্রী, জাতীয় খেলোয়ার, আন্তর্জাতিক আম্পায়ার ছাড়াও চট্টগ্রামের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক নানান অঙ্গণের খ্যাতিমান ব্যক্তিত্বদের নাড়ির সূত্র এই উত্তর কাট্টলী।
কিন্তু নানান কারণে দিনে দিনে চট্টগ্রামের প্রবেশদ্বার এই অঞ্চলটি তাঁর ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। এরমধ্যে অন্যতম মাদক, কিশোর গ্যাং আর অসহিষ্ণু গ্রুপিং ও অপরাজনীতি। অন্যদিকে ওয়ার্ডটিকে বসবাসগতভাবে নানানভাবে ঝুঁকিতে ফেলেছে এই অঞ্চলে গড়ে ওঠা অসংখ্য শিল্পকারখানা। যদিও এসব শিল্পকারখানাতে এই অঞ্চলের মানুষেরা কাঙ্খিত প্রত্যাশা অনুসারে নিয়োগ বঞ্চিত। এখানে গড়ে তোলা শিল্পকারখানা থেকে প্রতিদিন ট্রাকে করে অন্যান্য শিল্পকারখানার জন্য গভীর নলকূপ করে পানি উত্তোলন করে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়েও ওয়ার্ডবাসী শঙ্কিত।
এছাড়াও এই অঞ্চলে অপরাজনীতির মাধ্যমে কিশোর গ্যাং এর কার্যক্রম বেড়ে যাওয়ায় উঠতি তরুণ-তরুণীদের পরিবারগুলো রয়েছেন আতঙ্কে। বিভিন্ন চিহ্নিত স্পটগুলোতে মাদকসেবন ও বিক্রিতে সহায়তা করছে ছাত্র ও যুব সংগঠনের কতিপয় নেতারা। এছাড়াও নানান অসামাজিক কর্মকা- ও সড়ক দখল করে ভাসমান দোকান বসিয়ে, গাড়ি স্ট্যান্ড করে টোকেন ও চাঁদার বিনিময়ে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা হচ্ছে সাধারণ মানুষের নিরাপদ চলাচলে। এরফলে সড়কসমূহে যানজটসহ নানান অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটলেও এসবে হস্তক্ষেপ করেন না স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব ও জনপ্রতিনিধিরা। কারণ হিসেবে জানা গেছে, নিজেদের ব্যক্তিগত তৎপরতা ও রাজনৈতিক কর্মকা-ে এসব চাঁদাবাজ, দখলবাজ, মাদক ব্যবসায়ী ও সেবনকারীদের সহযোগিতা নেন কতিপয় নেতারা।
এই ওয়ার্ডে গত দুইবার কাউন্সিলর পদে জনপ্রতিনিধিত্ব করছেন নগর আওয়ামী লীগের সদস্য ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু। তাঁর দশকজুড়ে জনপ্রতিনিধিত্বকে চ্যালেঞ্জ ছুড়েছেন একাধিক প্রার্থী। বর্তমান কাউন্সিলরের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ দুর্নীতি ও ভূমিদস্যুতা। এ নিয়ে ওয়ার্ডে মানববন্ধনও হয়। তিনি এই ওয়ার্ডে নানান সড়ক উন্নয়ন, জলাবদ্ধতা নিরসন, সুপেয় পানির ব্যবস্থা, সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করেছেন দাবি করলেও তা স্থায়িত্বশীল হয়নি বলে এলাকার ভোটার ও এবারে নির্বাচনে প্রার্থীদের অভিযোগ।
তাদের দাবি- সড়ক, নালার উন্নয়ন নিয়মিত কাজ। এ কাজ যে কাউন্সিলরই আসুক তাকে করতে হবে। কিন্তু যে পরিমাণ বরাদ্দ এখানে এসেছে তার প্রতিটিতে দুর্নীতি, কমিশন বাণিজ্য হয়েছে তা প্রমাণিত। নতুন কোনো সড়ক তৈরিতো দূরের কথা বরং তার কারণে এখানে রাজনৈতিক গ্রুপিং এর পাশাপাশি নানান দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি এবং চাঁদাবাজ-সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয় দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। অভিযোগ রয়েছে কর্পোরেশন ও সরকার প্রদত্ত উন্নয়ন বরাদ্দ যথাযথভাবে এখানে ব্যয় করা হয়নি বরং পকেটস্থ হয়েছে।
তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে বর্তমান কাউন্সিলরের ব্যক্তিত্ব, ব্যক্তিগত অর্জন আর সামাজিক সম্পৃক্তাতা তাকে এগিয়ে রেখেছে বলে মনে করেন তার সমর্থক, শুভাকাঙ্খীরা। অন্যদিকে এখানকার অনেক সাধারণ ভোটার ও অন্যান্য কাউন্সিলর প্রার্থীরা বলছেন, সৌন্দর্য, ব্যক্তিত্বসম্পন্ন হলেই চলবে না- এলাকার যথাযথ উন্নয়ন ও নাগরিক সমস্যা সমাধানে কাউন্সিলর আন্তরিক নন। তিনি এলাকার বিচার-সালিশ করেন যেগুলো সহজেই করা যায়। কিন্তু তার কোনো অনুসারি যদি অভিযুক্ত হন তখন তিনি সেই বিচার না করে দু’কূল বাঁচাই পদ্ধতি গ্রহণ করেন। ফলে অনেকে বাধ্য হন মামলা-মোকদ্দমায় জড়াতে যা স্থানীয়ভাবেই সমাধান করা সম্ভব।সড়কের উপর সড়ক করেছেন, কিন্তু নতুন সড়ক সৃষ্টি করেননি যা এই ওয়ার্ডে অতিগুরুত্বপূর্ণ।
স্থানীয় রাজনীতি সচেতন এলাকাবাসী, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও ভোটারদের কাছ থেকে জানা গেছে, তারা ভালো একজন জনপ্রতিনিধি চান যিনি বরাদ্দ আনতে পারবেন এবং তা সঠিকভাবে প্রয়োগ করে এলাকার উন্নয়ন ঘটাতে পারবেন। এলাকার ঐতিহ্য রক্ষায় অবদান রাখতে পারবেন। এলাকায় খেলার মাঠ, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডের পরিধি বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারবেন। তারা বলেন,‘আমরা গত ১০ বছর একজনকে দেখেছি। একজন নেতৃত্ব চিনতে ১০ বছর অনেক সময়। আমরা নতুন কর্মঠ, ভালো একজন জনপ্রতিনিধি চাই যিনি নিজের ভাগ্যোন্নয়ন নয়, মানুষের কল্যাণে নিবেদিত থাকবেন’।তাঁদের মতে, এখানে আমরা যাদের নাম শুনছি তাদের অনেকেই কাউন্সিলর প্রার্থী হওয়ারও যোগ্য না। অনেকে নিজের ব্যক্তিগত পরিচিতির জন্য কাউন্সিলরপ্রার্থী হিসেবে নিজেদের প্রচার করছেন। এ জন্য এখানে প্রার্থী সংখ্যা অনেক বেশি। তবে সাধারণ ভোটাররা যদি সঠিকভাবে ভোট দিতে পারে তাহলে ভালো জনপ্রতিনিধিই এখানে নির্বাচিত হবেন বলে তাদের প্রত্যাশা।
এই ওয়ার্ডে আসন্ন চসিক নির্বাচনে বর্তমান কাউন্সিল নিছার উদ্দিন আহমেদ ছাড়াও এবার প্রার্থী হিসেবে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন চেয়ে মাঠে নেমেছেন ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী, যুবলীগ নেতা মনোয়ারুল আলম চৌধুরী নোবেল ও ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের অন্যতম যুগ্ম আহ্বায়ক মো. গিয়াস উদ্দিন জুয়েল। অন্যদিকে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি রফিক আহমেদ, নগর বিএনপির যুব বিষয়ক সম্পাদক আব্বাস রশিদ, নগর যুবদলের সহ-সভাপতি শাহেদ আকবর। তবে গত নির্বাচনে ২০ দলীয়প্রার্থী হিসেবে ডা. শাহাদাত হোসেন নির্বাচন করলেও তিনি এবার নির্বাচন করবেন না বলে জানিয়েছেন। তবে একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, বিএনপি নির্বাচনে গেলে এবারো ডা. শাহাদাত হোসেনকেই প্রার্থী হিসেবে দেখা যেতে পারে। এছাড়াও চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদ্যাপন পরিষদের দপ্তর সম্পাদক কুমার দেব স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করবেন বলে জানা গেছে।
নতুন প্রার্থীদের মধ্যে সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী পরিবারের সন্তান। তাঁর বাবা মরহুম নুরুদ্দিন আহমেদ ছিলেন উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও নগর আওয়ামী লীগের শিল্প ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক। আরেক প্রার্থী মনোয়ার উল আলম নোবেল যুবলীগের রাজনীতি করেন। তিনি এই ওয়ার্ডের স্বনামধন্য নাজির বাড়ির ভাষা সৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীর ছোট ছেলে। এলাকার কাট্টলী নূরুল হক চৌধুরী উচ্চ ও প্রাথমিক বিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয়, কর্ণেলহাট বাজার ও মাঠসহ এই অঞ্চলে বিপুল সম্পত্তি দান করেছেন তাদের পরিবারের পূর্বপুরুষেরা। আরেক প্রার্থী মো. গিয়াস উদ্দিন জুয়েল ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচিত। তিনি ওয়ার্ডের জব্বার আলী সারেং বাড়ির বাসিন্দা।
অন্যদিকে বিএনপি থেকে মনোনয়ন প্রত্যাশী রফিক আহমেদ উত্তর কাট্টলী ওয়ার্ডের বিশ্বাসপাড়ার অধিবাসী। তিনি বিএনপির ওয়ার্ড কমিটির সভাপতিও। এছাড়াও আরেক প্রার্থী আব্বাস রশিদ ওয়ার্ডের সুলতান আহমেদ চৌধুরী চেয়ারম্যান বাড়ির বাসিন্দা। তিনি কাট্টলী আদর্শ সমিতিরও সভাপতি। অপর প্রার্থী শাহেদ আকবর ছাত্রদল শেষে এখন যুবদলের নগর কমিটির সহ-সভাপতি। তিনি ওয়ার্ডের কুতুববাড়ির ছেলে, পেশায় ব্যবসায়ী।

ডিসি/এসআইকে/আরবি