মিরসরাইয়ে বিরল বৃক্ষ হানজো ফল গাছ

বিরল বৃক্ষ হানজো ফল গাছ।

আজমল হোসেন, মিরসরাই  >>>
চট্টগ্রামের মিরসরাই উপজেলায় সন্ধান মিলেছে প্রায় দু’শ বছরের এক পুরাতন বৃক্ষের। হানজো ফল নামে পরিচিত এ বৃক্ষটি উপজেলার মিঠানালা রাম দয়াল উচ্চ বিদ্যালয়ের পুকুর পাড়ে দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। বছরের পর বছর এ গাছ নিয়ে এলাকার মানুষের কৌতুহলের অন্ত নেই। স্থানীয়দের দেওয়া ‘হানজ্ ফল’ নামেই এটি পরিচিত। গাছটির প্রকৃত পরিচয় এলাকার মানুষদের জানা না থাকলেও গাছটি মহুয়া গাছই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।
এক প্রতিবেদক বছরের বিভিন্ন ঋতুতে গাছটির আচরণ, প্রাকৃতিক বিবর্তন ব্যাপক পর্যবেক্ষণের পর ফুল, ফল এবং বীজের তথ্য ও ছবি সংগ্রহ করে বিশেষজ্ঞদের মতামতের ভিত্তিতে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে। বের করা সম্ভব হয়েছে এটির প্রকৃত নাম, গুণাগুণ এবং আদি-অন্ত রহস্য।
জানা গেছে, নন্দ কেরানী নামে এক ব্যবসায়ী সখের বসে নিজেদের পুকুর পাড়ে এ গাছটি লাগিয়েছিলেন। স্থানীয়দের দেয়া তথ্যমতে, এটি আনা হয়েছিল মিয়ানমারের রেঙ্গুন শহর থেকে। স্থানীয় লোকজনের কাছে গাছটির প্রাকৃতিক আচরণ রহস্যময়। তাদের ধারণামতে- এ গাছে বছরের বসন্তকালে এক ধরণের ফল ধরে। যা দিনে ধরে এবং দিনেই পেকে (পরিপক্ক) খাওয়ার উপযোগী হয়। তাই তারা মিরসরাই’র আঞ্চলিক ভাষায় এটির নাম দিয়েছে ‘হান্জ ফল’। প্রকৃত বাংলায় যার নাম দাঁড়ায় ‘তাৎক্ষণিক ফল’। শুধু তাই নয়; এটিকে ইশ্বরের অলৌকিক সৃষ্টি মনে করে মানত করা হয়। রোগ মুক্তি, বিপদ-আপদে রক্ষা ও ইশ্বরের কৃপা প্রার্থণায় ফুল, পাতা, গাছের ছাল এবং ফল দিয়ে করা হয় পূর্জা অর্চনা। বছরের পর বছর গ্রামের সাধারণ, অতি সাধারণ এবং শিক্ষিত শ্রেণি-পেশার লোকজনও এই ধারণাকে বিশ্বাস করে আসছেন।
বিরল প্রজাতি বলে ধারণা করে ২০১২ সালে গাছটি নিয়ে গবেষণা শুরু করে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেষ্ট্রি বিভাগ। বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. মোশাররফ হোসেন গবেষণার কাজ হাতে নেন। তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগ ফল, শাখা-প্রশাখা’র ছবি দেখে জানিয়েছেন ‘গাছটি আমাদের দেশেও আছে তবে সংখ্যায় কম। এটি ভারতের খুব পরিচিত একটি গাছ। এটি সংস্কৃতে ‘মধুকা’, হিন্দিতে ‘মহুয়া’ বা ‘মউয়া’ নামে পরিচিত। এদেশে এ গাছের সংখ্যা কম হলেও ভারতের গুজরাট, কর্নাটক, মহারাষ্ট্র, উড়িষ্যা, তামিলনাড়–, পশ্চিমবঙ্গসহ উপমহাদেশের প্রায় সর্বত্র কমবেশি এ গাছের সন্ধান মেলে। তবে জায়গা ভেদে নামের ক্ষেত্রে তফাত দেখা যায়। তবে বাংলা সাহিত্যে বিশেষ করে নজরুল তাঁর একাধিক কবিতা ও গানে মহুয়া ফুলের বন্দনা করেছেন। এছাড়া এদেশের নৃ-গোষ্ঠীর গানেও মহুয়ার উপস্থিতি উল্লেখ করার মতো।
মিরসরাইয়ের মিঠানালা গ্রামের মানুষের বিশ্বাস- গাছটির ফল, পাতা, বাকল ও ফুল খেলে কঠিন রোগ থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। বসন্ত এলেই এ গাছ দেখতে এবং একটি ফল এবং ফুল মানত করে খেতে দূরদূরান্ত থেকে লোকজন আসেন। গাছের ছায়ায় প্রতিক্ষায় থাকেন ঘন্টার পর ঘন্টা। গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকরা ভোর বেলায় গাছের নিচে পূজা দেন পাপ মুক্তি আর স্বর্গ লাভের আশায়।
দৈনিক চট্টগ্রামের এই প্রতিবেদক দীর্ঘ পর্যবেক্ষণ কররে দেখতে পান, বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে (বাংলা ফালগুন) ভোরে ডালে শোভা পায় ফুল, সূর্যোদয়ের মুহুর্তে কিছুটা ফলের আকৃতি ধারণ করে। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে না হতেই আবরণ আর রং বদলে এটি ধারণ করে সাদা রং। ১০ ঘন্টা সময়ে পেকে খাওয়ার উপযোগী হয়। এছাড়া গ্রীষ্ম-বর্ষায় অন্য একটি ফল ধরে এ গাছে।
এই প্রতিবেদকের দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, শুধুমাত্র বসন্তকালে নয়, গ্রীষ্মের শেষ এবং বর্ষার শুরুতেও এ গাছে এক ধরণের ফল ধরে। এ বিষয়ে কয়েকজন বিশেষজ্ঞের সাথে কথা বললে তারা জানান- বসন্তে যাকে মানুষ ফল ভেবে বসে আছে প্রকৃত অর্থে তা ফল নয় ফুল। বসন্তকালে ফোটা ফুলের গর্ভাশয় থেকে গ্রীষ্মকালীন ফলটির উদ্ভব হয়।
স্থানীয়রা জানান, বসন্তের ফলটি খেতে খুব মিষ্টি (সু-স্বাধু)। তবে গ্রীষ্মকালের ফলটিকে তাঁরা ফল ভাবতে রাজি নয়। তাদের মতে এটি ফল নয় এক ধরণের গোটা (বীজ)। এটি খেতে সুস্বাদু নয়।
এ প্রসঙ্গে মিঠানালা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সফিউল আলম দৈনিক চট্টগ্রামকে জানান, গাছটির প্রকৃত পরিচয় না জানার কারণে স্থানীয়দের মধ্যে এটি নিয়ে প্রচুর কৌতুহল। এলাকার সবাই এটিকে ‘হানজ্ ফল’ গাছ নামেই চেনে।
এলাকার লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, মিঠানালা গ্রামের হানজ্ ফল (মহুয়া) গাছটির ফল থেকে বীজ সংগ্রহ করে চারা উৎপাদন সম্ভব হয়। কিন্তু চারা গাছটি রোপণের অল্প সময়ে মারা যায়। গত একশ বছরের ইতিহাসে অনেক চারা উৎপাদন এবং রোপণ করা গেলেও চারা গাছটির বয়স ৪-৫ বছর হতে-না হতেই মারা যায়। কলম কিংবা ডাল ভেঙ্গেও এলাকার মানুষ চারা উৎপাদনে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। মধ্যম মিঠানালা গ্রামের ৭২ বছর বয়সি খোরশেদ আলম শখ করে ২০১০ সালে বাড়ির আঙিনায় দু’টি গাছ লাগান। তার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় দু’টি গাছ এখনো সবল-সতেজ আছে। তবে খোরশেদ জানান, এর আগে যারা গাছের ছোট চারা এনে লাগিয়েছেন কেউই গাছটি বড় করতে পারেনি। আমার গাছটিও হয়তো মারা যাবে।
বিশেষজ্ঞের বক্তব্য :
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগি অধ্যাপক মোহাম্মদ জসীম উদ্দিন বলেন, ‘দেশে শতবর্ষী গাছের সংখ্যা কম। এদিক থেকে এ গাছের গুরুত্বও অনেক। তবে ওই গাছটি ঘিরে মানুষের একটু বাড়তি আগ্রহ খারাপ কিছু না। বরং গাছটিকে টিকিয়ে রাখতে এটা বেশ কাজে দেবে। এ গাছটি মহুয়া, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত’।
প্রকৃত নাম ও গুণাগুণ :
মিরসরাইয়ের মিঠানালা গ্রামের বিস্ময়কর গাছটির নাম ‘মহুয়া’ যার বৈজ্ঞানিক নাম ‘গধফযঁপধ খড়হমরভড়ষরধ অথবা গধফযঁপধ ওহফরপধ। এটি মধ্যম থেকে বৃহৎ আকারের একটি বৃক্ষ। এটির বৃন্ত ছোট, ফুল লম্বাকৃতির ও ফল ডিম্বাকার। ‘মহুয়া’ নিয়ে কাজ করে ভারতের রাজস্থানভিত্তিক একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ‘জাত্রফা’। জাত্রফার ওয়েব সাইট ঘেঁটে জানা যায়, এটি মধ্য ভারতের আদি বৃক্ষ। শুষ্ক অঞ্চলের গাছ হলেও আর্দ্র কোমল আবহাওয়াতেও ভালো জন্মায়। শীত মৌসুমে এটির সব পাতা ঝরে যায়। ভেষজগুণে সমৃদ্ধ ‘মহুয়া’। পাতা, বাকল, ফুলের নির্যাস ও তেলে বীজ নানা রোগের চিকিৎসায় বহুকাল থেকে ব্যবহার হয়ে আসছে। মৌসুমি সর্দি কাশি, অগ্নিমন্দ্য, আন্তিক রোগ, অর্শ, বাত-ব্যথা ও মাথার ব্যথা নিরাময় হয়। তাছাড়া পুরনো ক্ষত ও কীট দংশনেও এটি বিষ ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করে। সাঁওতালেরা মশার কামড় যন্ত্রণা ও কীটপতঙ্গের দংশনের ক্ষেত্রে মহুয়া বীজের তেল ব্যবহার করে। এ তেলের নির্যাস আদিবাসী সাঁওতালদের প্রিয় পানীয়। মহুয়া গাছের ফুল থেকে একধরণের দেশি মদ তৈরি হয়। ভারতের মহারাষ্ট্র ঝাড়খন্ড, উড়িষ্যা, পশ্চিমবঙ্গ এবং ছত্রিশগড়ের সাঁওতাল ও অন্যান্য উপজাতীয় সম্প্রদায় এই মদ তৈরি করে। কথা রয়েছে এ মদ খেলে হাতিরও নেশা হয়।

ডিসি/এসআইকে/এসআহো