সীতাকুণ্ডের পৌনে পাঁচশো বছরের প্রাচীন হাম্মাদিয়া মসজিদ

জয়নাল আবেদীন, সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি >>>
পৌনে পাঁচশো বছরের প্রাচীন সীতাকুণ্ডের হাম্মাদিয়া মসজিদ। ১০.৩৭ একরবিশিষ্ট একটি দিঘীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত। পাশেই রয়েছে কবরস্থান। দিঘীটি হাম্মাদিয়া দিঘী নামে সুপরিচিত।
উত্তর চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার ছোট কুমিরা ইউনিয়নের মসজিদা গ্রামে অবস্থিত হাম্মাদিয়া বা হামিদিয়া মসজিদ। সুলতানী আমলে নির্মিত মসজিদটি কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আজো। হাম্মিদিয়া মসজিদকে এখনো বর্তমান মসজিদগুলোর মধ্যে চট্টগ্রাম জেলার দ্বিতীয় প্রাচীন মসজিদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
ঐতিহাসিক প্রাচীন এই মসজিদটি এলাকার লোকজনের কাছে হাম্মাদিয়া মসজিদ নামে পরিচিত। পঞ্চাশ একশো কিংবা দুশো তিনশো নয়, অনেকটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় এই হাম্মাদিয়া মসজিদটি পৌনে পাঁচশো বছরের প্রাচীন সুলতানী আমলের ঐতিহাসিক নিদর্শন।
ছোট কুমিরা মসজিদা গ্রামে গোলাপী রঙের এক গম্বুজের হাম্মাদিয়া জামে মসজিদ। ২০১২ সালে প্রকাশিত ইন্টারনাল চিটাগাং বইয়ে হাম্মাদিয়া মসজিদকে চট্টগ্রামের দ্বিতীয় প্রাচীন মসজিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। হাম্মাদিয়া দিঘীর পশ্চিম পারে এবং ঢাকা চট্টগ্রাম মহাসড়কের পূর্ব পাশে অবস্থিত এই মসজিদ সরকারিভাবে সংরক্ষণ না করায় প্রাচীন এই মসজিদটির জৌলুস হারাতে বসেছে।
বৃহত্তর চট্টগ্রাম অঞ্চলের মধ্যে হাটহাজারীর ছয় গম্বুজবিশিষ্ট মসজিদ প্রাচীনতম। এর নির্মাণকাল (১৪৭৪-১৪৮১) খ্রিস্টাব্দ। সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহের সময় (১৪৭৪-১৪৮১) এটি নির্মিত হয়।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক আবদুল করিমের মতে, হাটহাজারীর ফকিরের মসজিদ এবং কুমিরার হাম্মাদিয়া মসজিদের স্থাপত্যরীতি একই। পার্থক্য এই হাটহাজারীর মসজিদ বড় এবং কুমিরার মসজিদ ছোট। সুলতানী আমলে কুমিরা থেকে হাটহাজারী পর্যন্ত একটি রাজপথ ছিল। এই দু’টি মসজিদ এই রাস্তার দুই প্রান্তে অবস্থিত ছিলো। সেই প্রেক্ষাপটে বলা চলে, কুমিরা মসজিদের নির্মাতা প্রকৌশলীরা হাটহাজারী মসজিদের স্থাপত্যশিল্পের দ্বারা প্রভাবিত হয়।
বাংলার শেষ হোসেন শাহী বংশের সুলতান গিয়াসউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৫৩৩-১৫৩৮) সময় তৎকালীন চাঁটগাঁও বন্দর শহরের ১২-১৩ মাইল উত্তর পশ্চিমে ৭ নম্বর কুমিরা ইউনিয়নের মসজিদিয়া গ্রামে এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি মসজিদ নির্মাণ করা হয়। মসজিদ নির্মাণের পর গ্রামের নাম রাখা হয় মসজিদিয়া।
মসজিদটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের পাশে অবস্থিত হলেও ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের অগোচরে থেকে গেছে বছরের পর বছর। ১৯৬৬ সালে ইতিহাসবিদ ড. আবদুল করিম (১৯২৮-২০০৭) সড়ক দিয়ে ঢাকা যাওয়ার পথে হাম্মাদিয়া মসজিদটি তার দৃষ্টি কাড়ে। মসজিদে স্থাপিত শিলালিপির পাঠোদ্ধারপূর্বক এশিয়াটিক সোসাইটির গবেষণা পত্রে প্রকাশ করেন তিনি।
মসজিদটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট একটি বর্গাকার ইমারত। এর প্রতি বাহু ৬.৩৪ মিটার এবং এর বাইরে চারকোণায় আছে চারটি সংযুক্ত চোঙ্গাকৃতির গোলাকার বুরুজ। মসজিদের পূর্ব দেয়ালে তিনটি খিলান দরজা এবং উভয় দক্ষিণ দেওয়ালের মাঝে একটি করে জানালা আছে। প্রতিটি দরজার বাইরে এবং ভেতরে আছে দুটি সুঁচ্যগ্র পাথরে খিলান ফ্রেম এবং দুয়ের মধ্যে আছে টোলের মত খিলান ছাদ।
মসজিদটির ভেতরে উত্তর এবং দক্ষিণ উভয় দেওয়ালে একটি করে বড় কুলঙ্গী আছে। এগুলো দেয়া হয় জিনিসপত্র রাখা ও বাতি জ্বালানোর কাজে ব্যবহারের জন্য। আদিতে উত্তর ও দক্ষিণ দিকের দেয়ালের জানালাগুলোতে পোড়ামাটির ফলক ছিলো। কিন্তু বর্তমানে এগুলোর পরিবর্তে লোহার গ্রিল বসানো হয়েছে।
এই মসজিদটির নির্মাণবৈশিষ্ট্য এমনই যে কেবল সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেনি। বর্ষাপ্রবণ বাংলাদেশে ভারী বর্ষণ থেকেও অনিন্দ্য সুন্দর এই ইমারতকে রক্ষা করেছে। ছোট পান্ডুয়া মসজিদ, আদিনা মসজিদ, দরসবাড়ি মসজিদ, ষাট গম্বুজ মসজিদ ও বাবা মসজিদে এসব অলংকরণ দৃশ্যমান হয়।
পৌনে পাঁচশো বছরের প্রাচীন এই মসজিদ বারে বারে অপরিকল্পিতভাবে সংস্কার করায় এর মূল স্থাপত্যশৈলী হারাতে বসেছে। চুন-রং লাগানোসহ সম্প্রসারণের কবলে পড়ে হারাচ্ছে এর প্রকৃত রূপ। প্রতিবারেই হাতুড়ি-শাবলের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে মসজিদটি। এতো প্রাচীন ও গৌরবময় ইতিহাসের নিদর্শন এই মসজিদ যে ঐতিহাসিক তা জানেন না এখানকার তরুণ-উঠতি ছেলে-মেয়েরাও।

ডিসি/এসআইকে/এমজেইউ