কক্সবাজারে বন্দোবস্তির জমি দখলে নিতে রাতারাতি আশ্রয়ণ প্রকল্প!

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
বৃটিশ আমলে বন্দোবস্তি করে পাওয়া এক সহকারী জজের পরিবারের আবাদি জমি দখল করতে ‘মুজিবনগর’ নাম দিয়ে ‘ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারের আশ্রয়ণ’ ব্যানারে ঝুপড়ি ঘর তুলেছেন এক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য (মেম্বার) ও তার বড় ভাই।  ব্যানারে দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, বঙ্গবন্ধুর দৌহিত্র সজীব ওয়াজেদ জয়, কক্সবাজার সদর আসনের সংসদ সদস্য সাইমুম সরওয়ার কমল ও জেলা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক পৌরমেয়র মুজিবুর রহমানের ছবি।  লেখা হয়েছে- ‘মুজিববর্ষের অঙ্গীকার, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার’।
আশ্রয়ণের উদ্যোক্তা ও সৌজন্যে কামাল উদ্দিন কামাল লিখে টানানো হয়েছে নিজের ছবিও।  কক্সবাজার সদরের খুরুশকুল ইউনিয়নের ১ নম্বর ওয়ার্ডের তেতৈয়া ‘রফিকের ঘোনা’ নামক এলাকায় এ ঘটনাটি ঘটেছে।  এতে সদর উপজেলা সহকারী কমিশনারের (এসিল্যান্ড) ইন্ধন থাকার অভিযোগ ওঠায় এ নিয়ে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।
দখলপ্রচেষ্টা চলা ওই জমির মালিক খুরুশকুল তেতৈয়া এলাকার বাসিন্দা মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ও তৎকালীন বৃটিশ-ভারতের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ফৌজ আর্মি সদস্য মৃত আবুল হোসেন।  উত্তরাধিকার সূত্রে এ জমির বর্তমান মালিক চট্টগ্রাম আদালতে কর্মরত সিনিয়র সহকারী জজ কামাল উদ্দিন, হাইকোর্টের আইনজীবী বোরহান উদ্দিন রব্বানীদের পাঁচ পরিবার।  তাদেরকে ‘জামায়াত-বিএনপি পরিবার’ বলে প্রচার করছেন দখলকাররা।
সিনিয়র সহকারী জজ কামাল উদ্দিনের বাবা স্থানীয় ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম (৭০) বলেন, বৃটিশ আমল থেকে খুরুশকুল মৌজার বিএস ৩৯৮ নম্বর খতিয়ানের বিএস ৪৪৬৬ দাগের তিন একর ৪৪ শতক জমি আমার বাবার নামে বন্দোবস্তি।  তখন থেকে খাজনা দিয়ে সেই জমির অর্ধেকে আমন-বোরো চাষ আর অর্ধেকে মৌসুমি নানা শস্য ফলিয়ে পরিবারের খোরাক জোগানোর ব্যবস্থা হয়ে আসছে।  ‘রফিকের ঘোনা’ বলে পরিচিত এসব জমির আশপাশের পাহাড়ে করা হয়েছে বনবিভাগের সামাজিক বনায়ন।  কিন্তু সম্প্রতি সেই সামাজিক বনায়নস্থলে কক্সবাজার বিমানবন্দর এলাকা থেকে উচ্ছেদে পড়া জলবায়ু উদ্বাস্তু শতাধিক পরিবারকে পুনর্বাসন করার জন্য স্থান নির্ধারণ করা হয়।  রফিকের ঘোনার সামাজিক বনায়ন ও পাহাড়ি জমি রক্ষায় বনায়নের উপকারভোগীদের পক্ষে মিজানুর রহমান নামের একজন হাইকোর্টে রিট পিটিশন দায়ের করেন (পিটিশন নম্বর-৪১৭০/২০২১)।  তা গ্রহণ করে বনে আশ্রয়ণ প্রকল্পে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেন উচ্চ আদালত।
তিনি আরও জানান, বিষয়টি জানার পর স্থানীয় এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের নাম ভাঙিয়ে স্থানীয় ইউপি সদস্য শেখ কামাল ও তার বড়ভাই কামাল উদ্দিন কামালের নেতৃত্বে একটি চক্র ১১ এপ্রিল রাতের আঁধারে আমাদের সবজি ক্ষেতের জমিতে দুই ডজনেরও বেশি ঝুপড়িঘর তৈরি করেন।  এসময় সশস্ত্র দুর্বৃত্তরা সবজি ক্ষেতের ফলনসহ নানা পণ্যের চারা উপড়ে ফেলেন।  বিষয়টি প্রশাসনকে অবগত করা হলেও এখনও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
অভিযুক্ত ইউপি সদস্য শেখ কামাল বলেন, ‘জায়গাটি ব্রিটিশ আমল থেকেই রফিকুল ইসলামের পরিবার ভোগ দখল করে আসছেন সেটা ঠিক।  আমরা এতদিন জানতাম জায়গাটি জোত।  কিন্তু সদর এসিল্যান্ড নিশ্চিত করেছেন জমিটি খাস খতিয়ান ভুক্ত।  এটি জানার পরই স্থানীয় গৃহহীনদের ঘর করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।  যারা ঘর করেছেন তাদের কারোরই নিজস্ব ঘর নেই।  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা না বলা পর্যন্ত এরা কেউ দখল ছেড়ে যাবে না।  জমিটি ‘বন্দোবস্তি’ প্রমাণ করতে পারলে সবাই উঠে যাবেন’।
সরেজমিন দেখা গেছে, আবাদি জমিতে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আদলে ২৭টি ঝুপড়ি ঘর তোলা হয়েছে।  কাজ চলছে আরও ২০-২৫টি ঘর তৈরির।  প্রশাসনিক বাধা রোধ করতে প্রথম ঘরটির বেড়ায় বঙ্গবন্ধু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সজীব ওয়াজেদ জয়ের ছবির পাশাপাশি স্থানীয় এমপি কমল ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌরমেয়র মুজিবের ছবিসহ মুজিববর্ষের স্লোগান সম্বলিত আশ্রয়ণ প্রকল্পের ব্যানার টানানো হয়েছে।  এর উদ্যোক্তা হিসেবে অভিযুক্ত কামাল উদ্দীন কামালের ছবিও এতে লাগানো রয়েছে।  ঝুপড়ির মাঝখানেও টানানো হয়েছে আরেকটি ব্যানার।  দখল বোঝাতে বসানো হয়েছে দুটি নলকূপ।  রাতে আলোর জন্য তার টেনে দেয়া হয়েছে একাধিক লাইট।
স্থানীয় অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এখানে দখলে আসা বেশিরভাগ দখলদারদেরই বাড়ি ভিন্ন ওয়ার্ডে আর তাদের আগ থেকে জমিজমা ও ঘর রয়েছে।  ভাড়াটিয়া ও নতুন করে ভিটা গড়তে উদ্যোক্তাদের টাকা দিয়ে অনেকে দখলে শরিক হয়েছেন।  জমিতে সবজি ক্ষেত নষ্ট করার চিহ্ন স্পষ্ট’।
একটি সূত্র জানায়, আশ্রয়ণ প্রকল্পে ঘর দেয়ার আশ্বাসে অনেকের কাছ থেকে ১০ থেকে ৪০ হাজার টাকা হাতিয়ে নিয়েছে স্থানীয় ইউপি সদস্য, তার বড়ভাইসহ একটি সংঘবদ্ধ চক্র।  উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে আশ্রয়ণ প্রকল্প আটকে যাওয়ায় বিপাকে পড়েন তারা।  ফলে নিরূপায় হয়ে রফিকের ঘোনার সবজি ক্ষেতের জমি দখলের পাঁয়তারা চালানো হয়।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্যোক্তা দাবিদার কামাল উদ্দীন কামাল টাকা নেয়ার বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘আদালতের নিষেধাজ্ঞা বা কী আছে সেটি অবিবেচ্য।  এ আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে গিয়ে জেল-ফাঁসি হলেও আমার কোনো আপত্তি নেই’।
খুরুশকুল ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন বলেন, আমার পরিষদের এক নম্বর ওয়ার্ড সদস্য বিচারক কামাল উদ্দিন পরিবারের আবাদি জমি জবরদখলের পাঁয়তারার বিষয়টি জেনেছি।  তিনি বলেন, কামালের পূর্ব-পুরুষরা ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা বলা চলে।  তার বাবা রফিক বর্তমানে আওয়ামী লীগের ওয়ার্ড সভাপতি।  তাদের জমি দখলের বিষয়টি সংশ্লিষ্ট প্রশাসনকে অবগত করেছিলাম।
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও পৌরমেয়র মুজিবুর রহমান বলেন, ‘শেখ কামালকে পছন্দ করি বলে খেয়ে না খেয়ে সাহায্য সহযোগিতা করি।  এটার মানে এই নয়, আমার নাম ব্যবহার করে অপরাধ করবে’।  তিনি বলেন, কোনো জমি দখলের সঙ্গে আমি জড়িত নই।  বিষয়টা খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নেয়া হবে।
নিজের ছবি টানিয়ে জমি দখলের বিষয়ে জানতে এমপি সাইমুম সরওয়ার কমলের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।  পরে ক্ষুদেবার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
কক্সবাজার সদর সহকারী কমিশনার (ভূমি) নু-এমং মারমার মং উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা অমান্যে দখলদারদের উসকানির বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, ‘মহামান্য হাইকোর্টের নির্দেশনার পর এ বিষয়ে আমি আর মাথা ঘামাইনি’।

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ