বরিশালের ঘটনা প্রতিমন্ত্রী-মেয়রের দ্বন্দ্বের ফসল

দৈনিক চট্টগ্রাম ডেস্ক >>>
সামান্য ব্যানার অপসারণকে কেন্দ্র করে বরিশালে সম্প্রতি যে ঘটনা ঘটেছে তার নেপথ্যের তথ্য বেড়িয়ে আসছে দ্রুতই। এই ঘটনার নেপথ্যের কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ও স্থানীয় সংসদ সদস্যদের আধিপত্য বিস্তারকে। ওই সংসদ সদস্য আবার সরকারের প্রতিমন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। আর তাদের এই বিবাদের ফাঁদে পড়ে স্থানীয় রাজনীতির নেতিবাচক ইস্যুটি এখন জাতীয় আলোচিত ইস্যুতে পরিণত হয়েছে। যদিও আজ সোমবার বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্তাদের সাথে সকল পক্ষের বৈঠকে বিষয়টি সমঝোতায় চুকিয়ে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
জানা গেছে, উপজেলা পরিষদের চত্বর থেকে ব্যানার অপসারণ নিয়ে গত বুধবার রাতে ইউএনও’র বাসভবনে হামলা করেন বরিশাল সিটির মেয়র সেরনিয়াবাত সাদিক আবদুল্লাহ’র অনুসারী যুবলীগ-ছাত্রলীগ-আওয়ামী লীগের কর্মীরা। ওসব ব্যানার ছিল বরিশাল সদর আসনের সাংসদ ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী কর্নেল (অব) জাহিদ ফারুক শামীমের অনুসারীদের। ওই রাতের হামলা-সংঘর্ষের ঘটনায় মেয়রসহ তাঁর পক্ষের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে পরদিন দুটি মামলা করে পুলিশ প্রশাসন। এর বিপরীতে গতকাল দুটি পাল্টা মামলা হয়েছে আদালতে। ইউএনও মুনিবুর রহমান, কোতোয়ালি থানার সদ্য সাবেক ওসি নুরুল ইসলামসহ বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলার আবেদন করেন সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র রফিকুল ইসলাম খোকন এবং আরেক কর্মকর্তা। আদালত মামলাটি গ্রহণ করে পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দিয়েছেন।
স্থানীয় কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা জানান, প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক আওয়ামী লীগের প্রার্থী হয়ে সদর আসনে প্রার্থী হলে ওই সময় সাদিক আবদুল্লাহ তাঁর সঙ্গে প্রচারণায় ছিলেন। কিন্তু জাহিদ ফারুক সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর ধীরে ধীরে দূরত্ব বাড়ে দুজনের মধ্যে। প্রতিমন্ত্রীর অনুসারীরা অভিযোগ করেন, নানা সময় সভা-সমাবেশে অবজ্ঞা ও অসম্মান করা হয়েছে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুককে। যে কারণে দূরত্ব বাড়ে তাঁদের মধ্যে। এর বহিঃপ্রকাশ ঘটে কিছুদিন আগের দলের কেন্দ্রীয় প্রেসিডিয়াম সদস্য জাহাঙ্গীর কবীর নানকের বাসভবনের একটি অনুষ্ঠানে। সেখানে মেয়র সাদিক প্রকাশ্যে এমপি জাহিদ ফারুককে উদ্দেশ করে নালিশ করেন নানকের কাছে। ওই সময় মেয়র নানককে জানান, প্রতিমন্ত্রী দলীয় নেতা-কর্মীদের পাশে থাকেন না। এ ঘটনায় দুজনের বিবাদ প্রকাশ্যে চলে আসে। এরপর থেকে প্রতিমন্ত্রী ও মেয়রকে আর এক মঞ্চে দেখা যায়নি। বিভিন্ন সামাজিক-রাজনৈতিক অনুষ্ঠানে ভিন্ন ভিন্নভাবেই অবস্থান দেখা মেলে তাঁদের। আর সেই প্রকাশ্য বিবেধের সর্বশেষ রূপ হলো গত বছর নগর আওয়ামী লীগের কমিটিতে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুকে সদস্য হিসেবেও রাখা হয়নি। যদিও নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক পদপ্রার্থী ছিলেন তিনি।
আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে কথা বলে আরও জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীমকে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজে বরিশাল সদর উপজেলা চত্বরে সরব দেখা যায়। বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী উপহারসামগ্রী বিতরণ, আশ্রয়ণ প্রকল্পের উদ্বোধন, খেলাধুলার উদ্বোধন, সমাজসেবার মাধ্যমে বিভিন্ন অনুদান প্রতিমন্ত্রীর মাধ্যমেই দিত জেলা প্রশাসন। উপজেলা পরিষদ চত্বর অনেকটা একচেটিয়া ঘাঁটি হয়ে দাঁড়ায় জাহিদ ফারুকের। যে কারণে সেখানে নানা দিবসে কর্মসূচিতে ব্যানার ফেস্টুনে ভরে যেত তাঁর নামে। এর ওপর চলতি মাসে নগরের বিভিন্ন ওয়ার্ডে সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলরদের দিয়ে ত্রাণ বিতরণ করান প্রতিমন্ত্রী। নগরীর ছয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর প্রকাশ্যেই জাহিদ ফারুককে সমর্থন করেন। তাঁর অনুসারী হতে যাচ্ছেন আরও ১৫ জন কাউন্সিলর। নগরীর মধ্যে এভাবে জাহিদ ফারুকের তৎপরতা মোটেও ভালোভাবে নিতে পারেননি মেয়র ও তাঁর অনুসারীরা।
মেয়রকে নিয়ে কাউন্সিলরদের মধ্যেও ক্ষোভ আছে। নগরীর ২৩ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর এনামুল হক বাহার বলেন, ‘সিটি কর্পোরেশনে আমাদের কোনো কাজ নেই। কাউন্সিলররা কোন পরিস্থিতিতে আছেন বলার ভাষা নেই। যে কারণে ১৫ থেকে ২০ জন কাউন্সিলর নগরভবনে যান না’।
মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি জসীম উদ্দিন বলেন, ‘আমাদের ওপর অন্যায় করা হয়েছে। দলের দুঃসময়ে আমরা পাশে ছিলাম। কিন্তু রেজা হত্যা মামলায় আমাকে অনেক ভোগানো হয়েছে। আমার বাড়ি ভাঙতে গেছে। বরিশালবাসী জানেন এসব কে করেছে। যার ফল এখন ভোগ করছে’।
তবে বরিশাল সিটি কর্পোরেশনের প্যানেল মেয়র ও মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি গাজী নঈমুল হোসেন লিটু বলেন, প্রতিমন্ত্রী যে ত্রাণ কাউন্সিলরদের মাধ্যমে নগরীতে দিচ্ছেন তা তো প্রধানমন্ত্রীর। প্রতিমন্ত্রীর ব্যানার অপসারণের জন্য তো সিটি কর্পোরেশনের লোকজন যাননি। তাঁরা নগরীর সৌন্দর্য রক্ষায় সব ধরনের ব্যানার অপসারণ করছেন। এ নিয়ে জল ঘোল করছে একটি মহল।
মেয়র পক্ষের কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে প্রতিমন্ত্রীর কার্যক্রমের মূল কেন্দ্র হয়ে ওঠে উপজেলা পরিষদ চত্বর। জেলা প্রশাসন বা উপজেলা প্রশাসনও তাদের বিভিন্ন কর্মসূচিতে প্রতিমন্ত্রীকে প্রাধান্য দিতেন। এ নিয়ে অবহেলিত মনে করতেন মেয়র।
অন্যদিকে প্রশাসনের কয়েকজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, তাঁদের কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাত নেই। কিন্তু বিভিন্ন সময় মেয়রের কথাবার্তা এবং আচরণ তাঁদের ব্যথিত করেছে। এ কারণে তাঁর প্রতি কর্মকর্তাদের কিছু হলেও অসন্তোষ রয়েছে।
গত বুধবার রাতের ঘটনার নেপথ্যের বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মুনিবুর রহমান সরাসরি কিছু বলেননি। তিনি গতকাল রবিবার বলেন, ‘মামলার এজাহারেই সব উল্লেখ করেছি। ওই ঘটনায় ছাত্রলীগ, যুবলীগ নেতা ও মেয়রকে আসামি করা হয়েছে’।
মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আফজালুল করিম বলেন, ‘প্রথমত মনে করি, ইউএনও মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছেন। তিনি পরিস্থিতি তৈরি করে গুলির নির্দেশ দিয়েছেন। উপজেলা পরিষদের ব্যানার তো ইউএনও’র না। সিটি কর্পোরেশনের কাজে তিনি কেন বাধা দেবেন?’

ডিসি/এসআইকে/এমএসএ